শনিবার, ১৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

ইতিহাসের সাক্ষী ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়ি

রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর

ইতিহাসের সাক্ষী ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়ি

ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়ি। সোয়া ২০০ বছরের পুরনো ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়িটি অতীত ঐতিহ্যের নীরব সাক্ষী হয়ে  দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে এটি ভুলতে বসেছেন। অথচ জমিদারবাড়ির স্থাপনা সংস্কার করা হলে নতুন প্রজন্মের নিকট শিক্ষণীয় বিষয় হওয়ার পাশাপাশি দর্শনীয় কেন্দ্র হতে পারে। দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে পুনর্ভবা নদীর কোল ঘেঁষে নিরিবিলি-কোলাহলমুক্ত ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়ির এ গ্রামটি অবস্থিত।

জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে দিনাজপুর জেলায় যে কজন জমিদার ছিলেন তার অন্যতম ঘুঘুডাঙ্গার জমিদার। তৎকালীন দিনাজপুরের ১১টি থানায় এই জমিদারের এস্টেট ছিল। এ এস্টেট থেকে বার্ষিক ১ লাখ টাকা খাজনা দিতে হতো ব্রিটিশ সরকারকে। জমিদারের আওতায় ১৮টি কাচারি ও ৪১টি তহসিল অফিস ছিল। ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বংশের গোড়াপত্তন করেন নবীর মোহাম্মদের পুত্র ফুল মোহাম্মদ। ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারির স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ৮০ বছরের মতো। তবে কবে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারি শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেননি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৭১ সালে চালু পঞ্চসনা ব্যবস্থা পরবর্তীতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নীতিতে ১৭৮৯ সালে দশসালা নীতি চালু করে। ১৭৭১ হতে ১৭৮৯ সালের মধ্যে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারির সূচনাকাল। আর ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ জমিদারি অটুট ছিল।

ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়িটি একতলা-দোতলা মিলে একটি অনুপম পাকা ভবন। ভগ্নদশায় রয়েছে ফুল লতাপাতায় সজ্জিত বিরাট প্রবেশদ্বার। হাতি শালে হাতি, ঘোড়া শালে ঘোড়া। আর অন্যান্য জমিদার পরিবারের মতো ছিল পাইক-পেয়াদা, সিপাহি, বাবুর্চি, খানসামা, খামারু ইত্যাদি। ছিল একজন ম্যানেজার। বাহির বাড়িতে ছিল মেহমানখানা, সঙ্গে একটি সুদৃশ্য মসজিদ। সপ্তাহ বা মাসে বসত মেহমানখানা চত্বরে গ্রামপ্রধানদের আসর। আর এ আসরে আলোচনা হতো শান্তিশৃঙ্খলা, সামাজিক, চাষাবাদ ও আর্থিক বিষয়াদি নিয়ে। মেহমানখানার পিছন দিকে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার পরিবারের দুটি কবরস্থান রয়েছে।

ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার এস্টেটের একটি সোনার চেয়ার বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া ১০১ ভরি ওজনের সোনা দ্বারা তৈরি কৃত্রিম কই মাছ, রুপার বাট যুক্ত ছাতা, পাখা, রৌপ্য নির্মিত লাঠি, তামার ডেকচিসহ দুর্লভ সামগ্রী ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর হাতে লুণ্ঠিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালরাতে গণহত্যা শুরুর কয়েকদিন পর দিনাজপুরের বাঙালি, আর্মি, ইপিআর, পুলিশসহ মুক্তিবাহিনীর প্রায় ১৫০০ সদস্য, ২২টি যানবাহন ও প্রচুর অস্ত্রসহ ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ছাড়া শহরের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ পাক আর্মির অত্যাচারের ভয়ে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে। ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার পরিবারের সদস্যরা এ বিপুল সংখ্যক মুক্তিবাহিনী, কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের আহার বাসস্থানের ব্যবস্থা করে। পাকসৈন্যরা ঘুঘুডাঙ্গা অভিমুখে অগ্রসর হলে জমিদার পরিবারের সদস্যসহ সাধারণ মানুষ ঘুঘুডাঙ্গা ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নেয়। দেশ হানাদারমুক্ত হলে জমিদার পরিবারের সদস্যরা দেশে ফেরত আসেন। জমিদারবাড়িটি ধ্বংস হওয়ায় তারা ক্রমে দিনাজপুর শহরের ঈদগাহ আবাসিক এলাকায় তাদের নিজস্ব জায়গায় বাড়িঘর নির্মাণ করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর