মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাত্রার ব্যয়

বিশ্বজুড়েই বাড়ছে। সব জিনিসের দাম লাগামহীন। আবাসিক গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে অনেক স্থানে বেড়েছে বাসা ভাড়া। সঞ্চয় ভাঙার পর ক্রেডিট কার্ডে ধার করে দৈনন্দিন খরচ মেটাচ্ছেন অনেকে

মানিক মুনতাসির

নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাত্রার ব্যয়

করোনা মহামারি থেমে যাওয়ার পর বিশ্বে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে- প্রায় দেড় বছর আগে এমন আশঙ্কা থেকে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেছিল জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা এফএও। বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, বিশ্ব খাদ্য সংস্থার ওই সতর্কতা যেসব দেশ আমলে নিয়েছিল সেসব দেশে খাদ্য সংকট নেই। তবে খাদ্যপণ্যের দাম বেশ চড়া। এ ছাড়া মহামারি শেষ হলে বা করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার পর খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল এফএও। সে সময় অবশ্য আপৎকালীন তহবিল হিসেবে বহু দেশ খাদ্য মজুদ বাড়িয়েছে। বাংলাদেশও আমদানি এবং অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সংগ্রহ করে খাদ্যের মজুদ বাড়ায়। বর্তমানে সরকারের হাতে ১৬ লাখ টনের বেশি খাদ্যপণ্য মজুদ রয়েছে। একই সঙ্গে নিম্ন আয়ের মানুষকে নানাভাবে খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসছে সরকার। তবু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি পুরোপুরি।

এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে ঘি ঢেলেছে। ফলে জ্বালানির দাম বেড়েছে দফায় দফায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। তবে বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার প্রভাবটা একটু বেশিই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এর অন্যতম কারণ মনিটরিং না থাকা। এখানে বাজারে যে-যার মতো দাম বাড়ায়। কোনো জবাবদিহি নেই। কেউ কারসাজি করলেও শাস্তি হয় না। ফলে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ালেও এর কোনো প্রতিকার হয় না বলে মনে করেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

করোনা মহামারির বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বিশ্ব। বারবার কভিডের প্রাদুর্ভাব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কভিডজনিত বিধিনিষেধে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন কার্যক্রম। অব্যাহত রয়েছে সরবরাহ-ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতাও। সব মিলিয়ে ক্রমবর্ধমান রয়েছে মূল্যস্ফীতির চাপ। ফলে বিশ্বজুড়েই জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। সম্প্রতি বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোও এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে অব্যাহতভাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশে মূল্যস্ফীতির হার বর্তমানে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ চাপ সামনের দিনগুলোয় আরও বাড়তে পারে। এজন্য মানুষকে আয়-রোজগার বাড়াতে হবে। অন্যদিকে মিতব্যয়ী হতে হবে। কেননা বৈশ্বিক পরিস্থিতি প্রতিনিয়তই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে।’

কেস স্টাডি- : হাসিনা আক্তার। স্কুলশিক্ষক। রাজধানীতে ভাড়া বাসায় থাকেন। তিনি জানান, জুলাই থেকে বাড়ির মালিক বাসা ভাড়া বাড়ানোর নোটিস দিয়েছেন। এদিকে গ্যাসের দাম বেড়েছে। এক ডজন ডিম কিনতে গুনতে হচ্ছে ১৪০ টাকা। বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায় না। করোনা মহামারির পর বাচ্চাদের স্কুল খুলেছে। সেখানেও বাড়তি খরচ। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, দুজন আয় করেও সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

কেস স্টাডি- : ব্যাংক কর্মকর্তা খায়রুল হোসেন। নিজের কেনা ফ্ল্যাটে থাকেন। প্রতি মাসে ব্যাংক ঋণের কিস্তি শোধ করতে হয়। এতে বেতনের একটা বড় অংশ চলে যায়। এরপর বাবা-মায়ের ওষুধ। নিজের যাতায়াত খরচ। গৃহপরিচারিকার বেতন, অন্যান্য। সব মিলিয়ে প্রতি মাসেই কিছু না কিছু ঘাটতি থাকছে। ফলে ক্রেডিট কার্ড থেকে ঋণ করে বাজার খরচ চালাতে হচ্ছে মাঝেমধ্যেই।

বিভিন্ন গবেষণা বলছে, করোনা মহামারি চলাকালে মানুষ সঞ্চয় ভেঙে জীবন চালিয়েছে। মহামারি কেটে যাওয়ার পর সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে জিনিসপত্রের বাড়তি দাম। এর জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকেই দায়ী করছে সরকার। যদিও এ যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে খাদ্যপণ্যের দাম তেমন একটা বাড়েনি। এমনকি জ্বালানির দামও তুলনামূলক কম বেড়েছে সেসব দেশে। এ ছাড়া উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় সরকারের নানা সহায়তা চলমান রয়েছে। আবার ওই সব দেশে জবাবদিহিও রয়েছে। কেউ অযৌক্তিকভাবে জিনিসের দাম বাড়াতে পারে না। ফলে সেখানে এর প্রভাবটাও কম বলে মনে করেন ক্যাবের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান।

এদিকে টিসিবির হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে অন্তত ১৪ শতাংশ। আটা-ময়দার দাম বেড়েছে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত। সয়াবিন তেলের দামও বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া মাছ, মাংস, সবজি, তরকারি সব পণ্যের দামই বেড়েছে, এখনো বাড়ছে। অথচ মানুষের আয় বাড়েনি মোটেও। বরং করোনা মহামারির কারণে অনেকেরই আয় কমেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাদের অনেকেই আর ব্যবসা চালু করতে পারেননি। অনেকেই কাজ হারালেও কাজ ফিরে পাননি। এসব কারণও বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে দ্রব্যমূল্যের ওপর।

এদিকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি বৈশ্বিক ঝুঁকি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশসহ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোয় চলতি বছর সামাজিক অস্থিরতার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। ১৩২টি দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আগামী ছয় মাসের নাগরিক অস্থিরতা সূচক (সিভিল আনরেস্ট ইনডেক্স) প্রকাশ করেছে বৈশ্বিক ঝুঁঁকি ও কৌশলগত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফট।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিতে বিশ্বের সব দেশের সরকারের ওপরই চাপ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যম আয়ের দেশগুলো উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের সূচকে উচ্চ ঝুঁকি বা চরম ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর দুই-তৃতীয়াংশই বিশ্বব্যাংকের নিম্নমধ্যম বা উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের তালিকাভুক্ত। ম্যাপলক্রফট বলছে, এ বছর এমন অস্থিরতার ঝুঁকি রয়েছে অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতেও। এ ক্ষেত্রে যে ১০টি দেশকে আলাদাভাবে নজরে রাখার কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো- আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মিসর, তিউনিসিয়া, লেবানন, সেনেগাল, কেনিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ফিলিপাইন। প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারির সময়ে এ দেশগুলো তাদের জনগণের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে গিয়ে তারা এখন হিমশিম খাচ্ছে। খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এশিয়ার দেশগুলোর জন্য অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে উঠতে পারে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। বাড়ছে জ্বালানির দামও। এতে সবচেয়ে বিপাকে পড়ছে আমদানিনির্ভর দেশগুলো। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির এ সংকট ২০২৩ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে মনে করে সংস্থাটি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর