বুধবার, ২০ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা
বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রথম গুচ্ছগ্রাম

যারা ছিলেন সর্বহারা তারাই এখন সবচেয়ে সুখী

রফিকুল ইসলাম রনি, রামগতি (লক্ষ্মীপুর) থেকে

গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা- কথাটা শুনলেই অনেকে ধারণা করবেন গৃহহীন-ভূমিহীনদের বসবাস। সে ধারণাটা কিন্তু পাল্টে যাবে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গুচ্ছগ্রামে এলে। যারা ১৯৭২ সালে সব হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন এখানে, সেই সর্বহারারাই এখন সবার থেকে ভালো আছেন। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ২১০টি পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রতিটি পরিবারকে ২.৫০ একর করে ভূমি বন্দোবস্ত করেছিলেন। তাদের কারোরই এখন আর অসচ্ছলতা নেই। অধিকাংশ পরিবারই কোটিপতি ও খুব ভালো আছে। গতকাল সরেজমিন গ্রামটি ঘুরে এমন চিত্রই চোখে পড়েছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সর্বপ্রথম তৎকালীন নোয়াখালীর রামগতি উপজেলার চরবাদাম ইউনিয়নের চরপোড়াগাছা গুচ্ছগ্রামে এসেছিলেন। রামগতি লক্ষ্মীপুরের একটি উপজেলা। ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সফরসঙ্গীরা দুটি হেলিকপ্টারযোগে মেঘনা নদীর এ উপকূলে পৌঁছান। এ সময় উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দেশ আমাদেরই গড়তে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং প্রত্যেক বাড়িতে একটি করে লাউ গাছ হলেও লাগাতে হবে। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে দেশ গড়ার কাজ ও অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন এগিয়ে নিতে হবে।’ সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধু নিজেই কোদাল হাতে নিয়ে মাটি কাটা শুরু করেন রাস্তা নির্মাণের জন্য। এ দৃশ্য দেখে স্বেচ্ছায় ওড়া-কোদাল হাতে রাস্তা নির্মাণকাজে নেমে পড়ে সহস্রাধিক মানুষ। চরপোড়াগাছা গ্রামের সেই গুচ্ছগ্রাম বর্তমানে ‘শেখের কিল্লা’ নামে সুপরিচিত। সেখানে নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্তৃতিস্তম্ভ।

চরপোড়াগাছা গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাম উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় তার বাড়ির আঙিনায়। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা চরলক্ষ্মী গ্রামের বাসিন্দা ছিলাম। সেই গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় আমরা ভূমিহীন হয়ে পড়ি। এর আগে ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের এলাকা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চরপোড়াগাছা এসে এ গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। আমার মতো অনেকেই এ প্রকল্পে আশ্রয় পায়।’ তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি। দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু জমিজমা কিছুই ছিল না। জাতির পিতার দেওয়া জমিতে আমরা এখন খুব ভালো আছি। কেউ আমাদের ছোট করে দেখে না।’ জাতির পিতার হাতে শুরু করা গুচ্ছগ্রামের ধারণা কাজে লাগান তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আশ্রয়ণ প্রকল্প হাতে নেন। এখন ‘আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প’ নামের বাস্তবায়ন করছেন। তাঁর ঘোষণা- ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না।’ ইতোমধ্যে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে দেশের ৫২ উপজেলা ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত করেছে সরকার।

পঞ্চগড় ও মাগুরা জেলায় এখন আর কেউ ভূমিহীন ও গৃহহীন নেই। এ দুই জেলার উপজেলাসহ দেশের মোট ৫২ উপজেলা এখন ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত। আগামীকাল দুই জেলা ও ৫২ উপজেলাকে গৃহহীনমুক্তের ঘোষণা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। ওইদিন আরও ২৬ হাজার ২২৯ পরিবারকে ঘর উপহার দেবেন সরকারপ্রধান।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ লাখ ৯ হাজার ৩৭০ পরিবারকে ভূমি ও সেমিপাকা ঘর করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্বাহী সেলের মাধ্যমে ৭ হাজার ৮০৯ পরিবার, ভূমি মন্ত্রণালয় ৭২ হাজার ৪৫২ পরিবার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৪ হাজার ২৩৭ পরিবার, বাংলাদেশের গৃহায়ণ তহবিল থেকে ৮৮ হাজার ৭৮৬ পরিবার এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২৮ হাজার ৬০৯ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এভাবে সারা দেশে মোট ৭ লাখ ১১ হাজার ৬৩ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

বিশাল এ গুচ্ছগ্রামের মধ্যে গিয়ে দেখা হয় ষাটোর্ধ্ব মেজবাহ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বাড়ির আঙিনায় গোসল করছিলেন। সাংবাদিক দেখে দ্রুতই গোসল করে এসে বসলেন। ১৯৭০-এর স্মৃতিচারণা করলেন। তিনি বলেন, ‘৭০-এর সাইক্লোনে আমরা সব হারিয়েছি। সর্বহারা হয়ে গেছিলাম। বঙ্গবন্ধু দেখতে এসেছিলেন। আজকে যেটা সুন্দর গ্রাম দেখছেন, সেটা ছিল মরুভূমির মতো মাঠ। একটা চর। বঙ্গবন্ধু তখন আমাদের প্রতি পরিবারকে আড়াই একর করে জমি দিয়েছিলেন। এখানে দেখবেন প্রতিটি বাড়ি বিশাল, সামনে পুকুর সেটাও সরকারি। ১০ পরিবারের জন্য একটি দিঘি, মসজিদ, মন্দির, মাদরাসা, বাজার, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে।’

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান নুরুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘এখানকার বর্তমান জমির মূল্য প্রতি শতক ৫০-৬০ লাখ টাকা। সে হিসেবে বঙ্গবন্ধু যাদের বাড়ি ও জমি দিয়েছিলেন তার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় কোটি টাকার মতো হবে।’

হালিম নামে স্থানীয় বাসিন্দা জানান, আশপাশের অন্য গ্রামগুলোর তুলনায় এ গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা এখন বেশ অবস্থাপন্ন। তাদের অনেকেই এখন বড় গৃহস্থ। ইউরোপ-আমেরিকায়ও থাকেন কয়েকটি পরিবারের সদস্য।

সেখানে কথা হয় গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা সুমন চন্দ্র বৈদ্যের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর বাবা অনিল চন্দ্র বৈদ্য গুচ্ছগ্রাম সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁরাই এখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন। একসময় ৩০ ঘর হিন্দু এ গুচ্ছগ্রামে ছিল। বর্তমানে ১৭ ঘর হিন্দু আছে। তারাই এ মন্দিরটি ব্যবহার করেন। অর্থাভাবে মন্দিরটি পাকা করার কাজ শেষ হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব-১ এম এম ইমরুল কায়েস রানা বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভূমিহীন ও গৃহহীনদের পুনর্বাসনের জন্য যে যাত্রা শুরু করেছিলেন তাঁর কন্যা সে ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। একটি গৃহকে কীভাবে পারিবারিক কল্যাণে সামগ্রিকভাবে ভালো করা যায় তার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য বিমোচনে শেখ হাসিনা মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর