সোমবার, ২৫ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

কঠিন চ্যালেঞ্জে শিল্প খাত

রুহুল আমিন রাসেল

কঠিন চ্যালেঞ্জে শিল্প খাত

দেশি-বিদেশি বহুমুখী সংকটে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে উৎপাদনমুখী শিল্প খাত। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের ব্যবসায়ীরা ভয়াবহ সংকটে পড়েছেন। সংকট উত্তরণে দ্রুত নীতিসহায়তা প্রয়োজন। রপ্তানিতে উৎসে করহার কমাতে হবে। কাস্টমসের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। পণ্যের উৎপাদন খরচ ও ব্যবসার পরিচালন ব্যয় কমাতে হবে। সহজ শর্তে শিল্প খাতে অর্থায়ন করতে হবে। মার্কিন ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সংকট সমাধানের লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যবসায়ী নেতারা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে এসব অভিমত ব্যক্ত করেন।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, চলমান জ্বালানি সংকট সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রপ্তানিতে মন্দাভাব। বিশ্ববাজারের চলমান মন্দা ঠেকাতে নীতিসহায়তা দিতে হবে। রপ্তানিতে নীতিসহায়তা প্রদানে যে ১ শতাংশ হারে উৎসে কর রয়েছে, তা কমাতে হবে। শিল্প খাতে পণ্য উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। কাস্টমসের হয়রানি বন্ধ করতে হবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, দেশের অর্থনীতির ৮৩ শতাংশের চাকা ঘুরছে বেসরকারি খাতের হাতে। চলমান বৈশ্বিক মন্দায় সরকারকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। ব্যবসার খরচ কমাতে হবে। কমাতে হবে আমদানি খরচ। এসএমই খাতে নীতিসহায়তা দিতে হবে। সহজ শর্তে শিল্প খাতে অর্থায়ন দিতে হবে। খেলাপিদের দিকে না তাকিয়ে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ঋণ সহায়তা দিতে হবে। 

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ না পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়েছেন। আর্থিক খাতের সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হবে। সরকারি সংস্থাগুলোকেও               ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিকেএমইএ কার্যকরি সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পোশাকশিল্প এখন চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। এক. বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের রপ্তানি আদেশ কমে আসা। দুই. গ্যাস সংকট। তিন. মার্কিন ডলারের সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়নে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। চার. কাস্টমসের নীতিগত দৈন্যতা। তবে বিশ্বমন্দা যতই হোক না কেন, বাংলাদেশের পোশাক খাত ভালো থাকবে। কারণ, কম দামের পোশাকের ক্রেতা থাকবেই। পোশাকশিল্পের অন্য তিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার তাগিদ দিয়ে বিকেএমইএর এই নেতা বলেন, দেশে এখন গ্যাস সংকট মোকাবিলার ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে রিজার্ভের দিকে না তাকিয়ে শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ডলার কেনাবেচার ক্ষেত্রে এক থেকে দেড় টাকা পার্থক্য রাখতে হবে। ব্যাংকগুলো এখন ডলারের যে ব্যবসা করছে, তা বন্ধ করতে হবে। কাস্টমসে এইচএস কোডের জটিলতায় আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এটা রপ্তানি খাতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করছে বলেও মনে করেন পোশাকশিল্প মালিকদের প্রতিনিধি এই নেতা।

এদিকে দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারকে গত ২১ জুলাই দেওয়া চিঠিতে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায়ীদের ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীদের পক্ষে শর্তসাপেক্ষে ঋণ শ্রেণিকরণ সুবিধা গ্রহণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য সব শ্রেণির ঋণ গ্রহীতার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। কেননা কভিড-১৯ ও ইউক্রেন সংকট প্রভৃতি কারণে সবাই একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এফবিসিসিআই বলেছে, কভিড-১৯, ইউক্রেন সংকট প্রভৃতি কারণে বৈশি^ক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা মোকাবিলা করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন। এ জন্য ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠনে বৃহৎ ও ক্ষুদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণির ঋণ গ্রহীতার জন্য মেয়াদি, চলমান ও তলবি ঋণ সব  ক্ষেত্রেই গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ মেয়াদ আট বছর নির্ধারণের অনুরোধ করেছে এফবিসিসিআই। পাশাপাশি  ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠনেও ন্যূনতম ডাউন পেমেন্টের হার বৃহৎ ও ক্ষুদ্র সবার জন্য একই হারে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে এফবিসিসিআই। এরআগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে গত ১৬ জুলাই দেওয়া এক চিঠিতে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী নন-কটন ফেব্রিক্সে তৈরি পোশাকের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নন-কটন ফেব্রিক্সে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বৈশি^ক বাজারে আমাদের অবস্থান তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই বিশ্বব্যাপী নন-কটন ফেব্রিক্সকে প্রস্তুতকৃত তৈরি পোশাকের মোট চাহিদার বিপরীতে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে নন-কটনে তৈরি পোশাকের কাঁচামাল তথা সুতা ও কাপড় স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হওয়া প্রয়োজন। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন নন-কটনে বিনিয়োগ বাড়বে, স্থানীয় শিল্পায়ন প্রসার, রপ্তানিতে লিড টাইম কমাসহ অধিক মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে বেশি পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা রপ্তানিকারকের হাতে থেকে যাবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে টেক্সটাইল খাতে নতুন বাজার সৃষ্টিতে উৎসাহিত, বিনিয়োগ আকর্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অধিক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিটেশনের জন্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত নন-কটন ফেব্রিক্সকে প্রস্তুতকৃত তৈরি পোশাকের জন্য বিশেষ নগদ সহায়তা  একটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এদিকে চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আপাতত গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে গত ২৩ মে চিঠি দেয় এফবিসিসিআই। সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসকে দেওয়া চিঠিতে বলেন, কভিড মহামারি ও ইউক্রেন সংকটের ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, উৎপাদন উপকরণসহ সব খাতে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, মাত্রাতিরিক্ত সার্বিক পরিবহন ব্যয় এবং মুদ্রা বিনিময় হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসা পরিচালনার খরচ অনেক বেশি বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি খাতে বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাবে শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে চলতি হিসাবে ঘাটতি হওয়ায় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও চাপ পড়ছে। সঞ্চয় কমে যাওয়ায় বিনিয়োগ ও ব্যাংক খাতের অর্থপ্রবাহে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

সর্বশেষ খবর