বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

উখিয়ায় ব্যতিক্রমী উঠান স্কুল

মাহবুব মমতাজী, কক্সবাজার (উখিয়া) থেকে ফিরে

উখিয়ায় ব্যতিক্রমী উঠান স্কুল

মা-বাবা শ্রমজীবী। সন্তানরা বাড়িতে থাকে একা। অনেকে বেড়ে ওঠে বাড়ির উঠানে খেলতে খেলতে। এ নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তায় থাকেন না বাবা-মা। শিশু কী শিখছে বা খাচ্ছে- তারও নেই গুরুত্ব। অথচ এগুলোই শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ চিত্র দেখা গেছে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার দুটি ইউনিয়নে। রাজাপালং এবং রত্নাপালং ইউনিয়নের বাসিন্দাদের শিক্ষার হার খুবই কম। অল্প বয়সেই বেশির ভাগ পরিবারের সন্তানরা ঝুঁকে পড়ে আয়-রোজগারে। শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছোট্ট শিশুদের শুরুতেই যদি ঠিক পথে চালানো যায়, তাহলে বড় হয়ে তাদের ভুল পথে পা দেওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে।  শিক্ষার হার বাড়াতে উখিয়ার কিছু স্বেচ্ছাসেবীর উদ্যোগে কয়েকটি এলাকায় বাড়ির উঠানে গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল। টিনের চাল এবং টিন আর বাঁশের বেড়া দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এসব স্কুল। মাটিতে ত্রিপল বিছিয়ে বসে পাঠদান করানো হয়। গ্রামের মধ্যে যে গৃহবধূ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কমপক্ষে এসএসসি পাস করেছেন তিনিই শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন।  রাজাপালংয়ের শৈলেরডেবা গ্রামে এমন একটি স্কুলে গিয়ে দেখা গেছে, ভিতরে ৮-১০টি শিশু খেলছে। পাশে বসা তাদের মায়েরা। চারপাশের বেড়াতে বর্ণমালা, সংখ্যা ও ছাড়ার পোস্টার সাঁটানো। এ ছাড়াও মাছ, পশু-পাখি এবং বিভিন্ন জীব-জন্তুর ছবি ও নাম টানিয়ে রাখা আছে। শিশুদের কারও হাতে মোটা কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল ও বাঁশ কেটে বানানো খেলনা। খেলনা সামগ্রীগুলোর কোনোটাতে রঙের নাম, কোনোটাতে বাংলা বর্ণমালা, কোনোটাতে ইংরেজি বর্ণমালা এবং কিছু কিছু খেলনায় বাংলা-ইংরেজির সংখ্যা লেখা রয়েছে। মায়েদের মধ্যে থাকা শিক্ষিকার দায়িত্বে থাকা একজন শিশুদের হাতে খেলনায় থাকা লেখাগুলো চিনিয়ে দিচ্ছেন।  কিছু সময় পরে শিক্ষিকা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন- ‘ওইটাতে কী লেখা?’ মায়িশা নামের তিন বছরের এক শিশু চিৎকার দিয়ে বলে উঠল- ‘নয়’। এমন সঠিক উত্তর দেওয়াতে অন্য সব শিশুসহ তাদের মায়েরা করতালি দিয়ে মায়িশাকে উৎসাহ দিতে থাকলেন। এভাবেই বাড়ির উঠানে খেলতে খেলতে শিখানো হচ্ছে শিশুদের।   তবে উখিয়ার উপজেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া এক পরিসংখ্যানে এখানকার শিক্ষার হার খুবই নিম্ন বলে দেখা গেছে। শৈলেরডেবা গ্রামটিতে খেলনা সামগ্রীতে পাঠদান ছাড়াও ডিজিটাল শিক্ষাতেও অভ্যস্ত হয়েছে শিশুরা। তারা ‘ভিএসও স্কুল অ্যাপস’ নামে একটি অ্যাপের মাধ্যমেও ক্লাস-পরীক্ষা দুটোই দেয়।

বাড়ি উঠানে থাকা এসব স্কুল পরিচালনায় কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে ভোলেন্টারি সার্ভিসেস ওভারসিজ (ভিএসও) নামে একটি বিদেশি সংস্থা। শাহাদাত উল্লাহ নামে তাদের একজন প্রজেক্ট অফিসার জানান, যারা শিখবে তাদেরই বাড়ির মধ্যে স্কুলের জন্য জায়গা থাকবে, শিক্ষকও স্থানীয়দের মধ্যেই একজন থাকবেন। পুরোপুরি স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগে পরিচালিত এমন স্কুল। উখিয়ার ৫টি ইউনিয়নের ৭৯টি গ্রামে এমন ১৫৮টি স্কুল গড়ে তোলার ফলে খেলতে খেলতে শেখা হচ্ছে শিশুদের। এসব স্কুল চলে ‘নো কস্ট, লো কস্ট’ পদ্ধতিতে। অর্থাৎ গৃহস্থালি সামগ্রী দিয়ে তৈরি করা শিক্ষা উপকরণ দিয়ে চলবে শিক্ষা।  খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৬১ দশমিক ৮০ বর্গ কিলোমিটারের আয়তনে উখিয়া উপজেলা। এর মোট জনসংখ্যা ২ লাখ ৭ হাজার ৩৭৯ জন। পুরুষ ১ লাখ ৪ হাজার ৫৬৭ জন এবং নারী ১ লাখ ২ হাজার ৮১২ জন। ৫টি ইউনিয়নে গ্রাম আছে ১১৮টি। বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রাক প্রাথমিক আছে ৭৮টি। মাধ্যমিক ১৩টি এবং নিম্ন মাধ্যমিক ৭টি। শিক্ষার্থীর হার ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশ।  উপজেলা শিক্ষা অফিসারের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, ওই উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৪টি। মোট শিক্ষার্থী ২৩ হাজার ৩৫০ জন। এর মধ্যে ১১ হাজার ৪৮০ জন বালক এবং ১১ হাজার ৮৭০ জন বালিকা। শৈলেরডেবা গ্রামের স্বেচ্ছাসেবী ওই স্কুলটির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক রাশেদা আক্তার জানান, স্কুলটিতে এক বছরেই তার মেয়ে বাংলা ছড়া, বাংলা-ইংরেজি সংখ্যা এবং বর্ণমালা শিখেছে। বাড়িতে তার বাচ্চাকে একটু সময় দিয়ে শুরু পড়াগুলো মনে করিয়ে দিতে হয়। আর বাকি সময়টুকু এই স্কুলেই পাঠদান করানো হয়।  শিক্ষিকা সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, কোনো কিছুই জোর করে শেখানো হয় না। বাচ্চাগুলো খেলার জন্য যা কিছু নেয়, তাতে কী লেখা আছে সেগুলোই পড়ানো হয়।

সর্বশেষ খবর