রবিবার, ৩১ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

আতঙ্ক ভুয়া ডিবিতে

গাড়িতে পুলিশের স্টিকার, ওয়াকিটকি লাইট নিয়ে ঘুরে বেড়ায়

সাখাওয়াত কাওসার

ঘটনা ১৬ এপ্রিল শনিবার বেলা আড়াইটার। রাজধানীর বাংলামোটর। দেওয়ান ইকবাল নামের এক ব্যক্তি তার গাড়ি মেরামতের জন্য বিসমিল্লাহ কার এসি সেন্টারে যান। নিজেকে পুলিশ সদর দফতরে কর্মরত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পরিচয় দেন। ওই গাড়িতে পুলিশের স্টিকার, ওয়াকিটকি, পুলিশের লাইট থাকায় বিশ্বাসও করেন ওয়ার্কশপ মালিক শাহ মোহাম্মদ লিটন। গাড়ির মেরামত বাবদ ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে ৫ হাজার টাকা দিয়ে ঠিক করে রাখতে বলেন।

রাত সাড়ে ১০টার দিকে একটি মোটরসাইকেলে করে ইকবাল পুনরায় ওই ওয়ার্কশপে যান। গাড়ির মধ্যে রাখা মানিব্যাগে ২০ হাজার টাকা ছিল দাবি করে তা উদ্ধার করে দিতে বলেন ওয়ার্কশপ মালিককে। রীতিমতো ভীত-সন্ত্রস্ত্র ও বিব্রতবোধ করেন লিটন। বাকি ৩০ হাজার টাকা না দিয়েই গাড়ি নিয়ে চলে যান পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয়দানকারী ইকবাল। হুমকি দিয়ে যান, যে কোনো মূল্যে তার টাকা উদ্ধার করে দিতে হবে। নইলে তিনি বড় ধরনের ক্ষতি করবেন। এ জন্য মানিব্যাগের ফিঙ্গার চেক করাবেন। পরবর্তীতে পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিকে ভুক্তভোগী ফোন দিলে তার নম্বর ব্লক করে রাখা হয়। সবশেষ গত মঙ্গলবার ওয়ারী এলাকা থেকে সেই ইকবালকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ। এ সময় তার কাছ থেকে দুটি ওয়্যারলেস, ডিবি জ্যাকেট, একটি কালো গ্লাসের প্রাইভেট কার, গাড়িতে লাগানো পুলিশের স্টিকার, হ্যান্ডকাফ, হাতুড়ি, রশি, পাঁচটি মোবাইল ফোন, লেজার লাইট জব্দ করা হয়। আরেক ঘটনা গত ১২ জুনের। সন্ধ্যায় খিলগাঁওয়ের খিদমাহ হসপিটালের সামনে কিছু লোক নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে স্থানীয় একজন ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে যায়। তার কাছে থাকা সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তারা তাকে রাজধানীর পার্র্শ্ববর্তী সাভার এলাকায় ছেড়ে দেয়। বিষয়টি অবগত হয়ে অভিযানে নামেন ডিবি তেজগাঁও বিভাগের এডিসি আনিচ উদ্দীন। দুই দিন পরই মো. খাইরুল আলম ও মো. ফারুক নামের দুজনকে হ্যান্ডকাপ, আইডি কার্ডসহ গ্রেফতার করেন। এ তো গেলে মাত্র দুটি ঘটনা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভুয়া ডিবি পরিচয়দানকারী দুর্বৃত্তরা সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের সামনে ওতপেতে থাকে। ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে বের হওয়া সহজ-সরল ব্যক্তিদের ডিবি পুলিশের স্টিকার সংবলিত গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। গাড়িতে থাকা ব্যক্তিদের ডিবির জ্যাকেট, আইডি কার্ড এবং আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য ডিবির সরঞ্জাম দেখেই তার সঙ্গে থাকা সবকিছু দিয়ে দেয়। তবে অনেকেই উল্টো হয়রানিতে পড়তে পারেন- এমন আশঙ্কায় থানা পুলিশকে অবগতও করেন না এমন অভিযোগও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতেই অন্তত ১০/১২টি ভুয়া ডিবি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এসব চক্রে বিভিন্ন বাহিনী থেকে চাকরি হারানো বিভিন্ন র‌্যাংকের সদস্যরাও রয়েছেন। তাদের সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মরত বেশ কিছু নীতিহীন সদস্যরাও জড়িত। চক্রে রয়েছেন বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নীতিহীন সদস্যও। এরা বিভিন্নভাবে চক্রগুলোকে সহায়তা করে থাকেন। সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশের কাছে গ্রেফতার হওয়া ইকবালের নেতৃত্বে পাঁচজনের একটি প্রতারক চক্র রয়েছে। চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে টার্গেট খুঁজতেন ইকবাল। পরে ভুক্তভোগীদের নিজেকে ডিবির কর্মকর্তা পরিচয়ে গাড়িতে তুলে নিতেন। এরপর তাকে হ্যান্ডকাফ ও রশি দিয়ে বেঁধে জিম্মি করা হতো। প্রচণ্ড মারধরের এক পর্যায়ে ভুক্তভোগীর সঙ্গে থাকা সবকিছু ছিনিয়ে নিতেন। মাঝে মাঝে ভুক্তভোগীর সঙ্গে থাকা ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে বা বিকাশের মাধ্যমে টাকা উঠিয়ে নিতেন। তাদের স্বজনদের ফোন দিয়ে টাকা আনতে বাধ্য করা হতো। মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পাস করা ইকবালের চক্রে বিভিন্ন বাহিনীর বরখাস্তকৃত সদস্য রয়েছে বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ভুয়া ডিবি চক্রের আবদুল বারেক নামের একজন হোতা রয়েছেন। ভুয়া ডিবি পরিচয়ে ডাকাতি এবং প্রতারণার মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন কমপক্ষে ২০ বার। তার হাতে তৈরি করা শিষ্যদেরই রয়েছে অন্তত সাতটি গ্রুপ। তারা রাজধানীসহ নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, ফেনী, মানিকগঞ্জ এলাকায় সক্রিয় রয়েছে।

এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী ও আইন সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচিত হবে এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। কারণ তাদের পরিচয় ব্যবহার করেই দুর্বৃত্তরা সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলেন। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংলগ্ন এলাকায়ও তাদের টহল বাড়ানো উচিত। সর্বোপরি বাহিনীতে কর্মরত সব সদস্যদের কঠোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা উচিত। এতে করে এ ধরনের অপরাধসহ অনেক অপরাধই কমে আসবে।

গতকাল ভুয়া ডিবির তৎপরতা নিয়ে কথা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের কাছে কিছু তথ্য এসেছে ভুয়া ডিবি সম্পর্কে। আমাদের একাধিক টিম এ নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া আরেকটি ঘটনা থকে জানা গেছে, গত ১০ এপ্রিল ভুয়া ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’-এর ডিএসও কর্মরত মো. রাসেল মিয়ার মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। রাসেলকে জোরপূর্বক একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে তুলে এলোপাতাড়ি মারপিট করে দুর্বৃত্তরা। তার সঙ্গে থাকা নগদ ৬ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ঘারিন্দা বাইপাস এলাকায় গুরুতর অবস্থায় ফেলে দেয়। পরবর্তীতে ২১ এপ্রিল এ ঘটনায় জড়িত থাকা রবিউল করিম সুলভ, মো. মাসুম বিল্লাহ মুন্না, ইউসুব কাজী, মো. জাকির হোসেন বাবু এবং মো. সেলিম মিয়াকে নাটোর, সিরাজগঞ্জ, গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে টাঙ্গাইল জেলা পুলিশ। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় লুণ্ঠিত টাকা হতে নগদ ২ লাখ ২০ হাজার টাকা, ব্যবহৃত দুই সেট ডিবি পোশাক, হ্যান্ডকাফ এক জোড়া, একটি সিগন্যাল লাইট, একটি লাঠি, একটি ওয়্যারলেস সেট।

গতকাল সন্ধ্যায় জেলা পুলিশ সুপার টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার এ প্রতিবেদককে বলেন, গ্রেফতারকৃতরা আন্তজেলা চক্র। তাদের একজন অন্য একটি দল নিয়ে গ্রেফতারের ঠিক আগের দিনও মানিকগঞ্জে এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে আড়াই লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। তিনি বলেন, আমাদের ধারণা এসব চক্রে বিভিন্ন বাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত সদস্য রয়েছে। নইলে তারা এতটা সুচারুভাবে অপারেশন করতে পারত না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর