শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে অবৈধ স্টাডি সেন্টার

♦ ভর্তি হলেই স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি ♦ ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ♦ এসব সনদ অবৈধ : ইউজিসি

আকতারুজ্জামান

সরকারের অনুমোদন ছাড়াই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে অর্ধ-শতাধিক স্টাডি সেন্টার। বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর নামে তারা দেদার বিলি করছে সনদ। স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি, ডিপ্লোমাসহ এমন কোনো ডিগ্রি নেই যে এই প্রতিষ্ঠানগুলো দিচ্ছে না। মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে একটি কোর্সে ভর্তি হলেই নির্দিষ্ট সময় পর কেউ পেয়ে যাচ্ছেন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘উচ্চশিক্ষিত হওয়ার’ সনদ। ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে অনেকক্ষেত্রে কোনো কোনো শিক্ষার্থী শুধু অনলাইনে যোগাযোগ করেই সংগ্রহ করছেন এই সনদগুলো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলছে- এই প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ। এগুলো চালানোর কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাই এসব ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার থেকে দেওয়া সনদগুলোরও কোনো বৈধতা নেই। আর শিক্ষাবিদরা বলছেন, এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না হওয়ায় স্টাডি সেন্টারগুলোর সনদ বাণিজ্য ঠেকানো যাচ্ছে না। তারা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।

ইউজিসির তথ্যমতে, ঢাকার অলিগলিতে অবৈধভাবে কার্যক্রম চলা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে, ধানমন্ডিতে (২৮ বি, রোড ৫) বিএসি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড; নিউক্যাসেল ল একাডেমি ওয়েস্ট (রোড ৮, বাসা ১১ ধানমন্ডি); একই ঠিকানায় ক্যামব্রিজ বিজনেস অ্যান্ড ল একাডেমি; ৬০৬ বড় মগবাজারে নিউ ক্যাসেল ল একাডেমি; বারিধারা ডিপ্লোমেটিক জোনে (রোড ৯, বাসা ৯) ব্রিটিশ স্কুল অব ল; বনানীতে (ব্লক ই) লন্ডন কলেজ অব লিগ্যাল স্টাডিজ নর্থ; ৫৮ কলাবাগানে লন্ডন কলেজ অব লিগ্যাল স্টাডিজ সাউথ; বনানী ব্লক এফ, রোড ৪ এ এডুক্যান ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড; ৪/১/এ মিরপুর রোড সোবহানবাগে ভূঁইয়া একাডেমি লিমিটেড। এ ছাড়াও অবৈধভাবে চলছে ১৯/১ পান্থপথে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি; ৮০/এ/১ সিদ্ধেশ্বরীতে লিংকনস হায়ার এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট; ৪০ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউতে দ্য লন্ডন স্কুল অব কমার্স, ঢাকা; গুলশান ১ নিকেতনে (ব্লক বি, রোড ৩, বাসা ৬৪) কিংস্টন ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি (কেআইএমটি); রমনায় ইস্কাটন গার্ডেন রোড ১৭/৬ এ ঢাকা সেন্টার ফর ল অ্যান্ড ইকোনমিক্সসহ আরও অর্ধ শতাধিক স্টাডি সেন্টার। গতকাল এই প্রতিবেদক ইস্কাটন গার্ডেন রোডে অবস্থিত ঢাকা সেন্টার ফর ল অ্যান্ড ইকোনমিক্স (ডিসিএলই) নামের স্টাডি সেন্টারে যান। দায়িত্বরত এক কর্মচারী প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে একটি মোবাইল নম্বর দেন। মোবাইলে কল করা হলে নিজেকে ডিসিএলইর প্রিন্সিপাল (অধ্যক্ষ) বলে পরিচয় দেন নূরুল ইসলাম। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় অথবা ইউজিসির কোনো অনুমোদন রয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি দেওয়া প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বা বৈধতা দেওয়ার এখতিয়ার দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির নেই। এ প্রতিষ্ঠানটি গত ৬০/৭০ বছর ধরে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে দাবি করে নূরুল ইসলাম বলেন, আমার ক্যাম্পাস ‘ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন’ এর সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশনপ্রাপ্ত। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনলাইনে ডিগ্রি নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ইউজিসি যদি এখন অবৈধ বলে তবে আমরা তো তাদের (ইউজিসির) মুখ বন্ধ করে রাখতে পারব না। 

তথ্যমতে, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’ অনুযায়ী সরকারের অনুমোদন ব্যতীত দেশের কোনো স্থানে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের নামে ক্যাম্পাস স্থাপন করা যাবে না। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের অধীনে দেশে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট কোর্স পরিচালনার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে আইনে। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও স্টাডি সেন্টারের ক্ষেত্রেও। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে রাজধানীতেই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে এসব স্টাডি সেন্টার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন লঙ্ঘনে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান থাকলেও এর প্রয়োগ না হওয়ায় এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল মান্নান প্রতিবেদককে বলেন, এসব স্টাডি সেন্টার সনদ বাণিজ্যও করছে। অবৈধ স্টাডি সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমার জানামতে কখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তাই সগর্বে চলছে এগুলো। তিনি বলেন, ইউজিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালীন আমি বেশ কয়েকবার অবৈধ এসব সেন্টার বন্ধ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের জানিয়েছিলাম। কিন্তু কখনোই এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউজিসির এক কর্মকর্তা জানান, প্রভাবশালী কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিও ভুয়া ও অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠান থেকে টাকার বিনিময়ে সনদ নিয়েছে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বরাবরই অনীহা দেখা যায় কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম প্রতিবেদককে বলেন, শুধু রাজধানীতেই প্রায় অর্ধ-শতাধিক স্টাডি সেন্টার গড়ে উঠেছে যেগুলোর কোনো অনুমোদন নেই। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া সনদ বৈধ হবে না। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর