শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

দাবিতে অনড় চা শ্রমিকরা

৩০০ টাকা মজুরির দাবি অব্যাহত, টালবাহানা মালিক পক্ষের, হয়নি সংকটের সমাধান

প্রতিদিন ডেস্ক

দাবিতে অনড় চা শ্রমিকরা

শ্রীমঙ্গলে গতকাল চা শ্রমিকদের বিক্ষোভ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে চা শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। এ নিয়ে বাগান মালিক কর্তৃপক্ষ, মজুরি বোর্ড, চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠকের পরও হয়নি সমাধান। মালিক পক্ষের মজুরি ১৪ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে শ্রমিকরা। মজুরি ৩০০ টাকা না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছেন। বাগানে চা পাতা তোলা বন্ধ থাকায় চা উৎপাদনও বন্ধ রয়েছে।

মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গত শনিবার থেকে সিলেটসহ সারা দেশের ১৬৭টি চা বাগানে একযোগে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করছেন শ্রমিকরা। এ নিয়ে আলোচনার জন্য গত বুধবার রাজধানীর বিজয়নগরের শ্রম ভবনে চা-শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের মধ্যে বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠক রাত ১১টা পর্যন্ত চললেও শ্রমিকদের দাবি পূরণ না হওয়ায় কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। বৈঠকে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩৪ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তবে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শ্রমিক ও সংগঠনের নেতারা। বৈঠকে বাংলাদেশ শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চা শ্রমিক সংগঠনের নেতা এবং মালিকরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে খালেদ মামুন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে। তবে এখনই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া ও মালিক পক্ষের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ২/১ দিনের মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এদিকে শ্রমিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত আসার আগ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাহী উপদেষ্টা রাম ভোজন কৈরি। তিনি বলেন, সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। উল্লেখ্য, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল আর স্লোগানে স্লোগানে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন চা-শ্রমিকরা। ৩০০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি করা না পর্যন্ত সারা দেশের চা-বাগানে কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন তারা।  বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের লংলা ভেলির সাধারণ সম্পাদক সঞ্জু গোস্বামী গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে আমাদের মজুরি ১২০ টাকা। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির বাজারে ১২০ টাকায় কোনোভাবেই সংসার চালানো সম্ভব নয়। আমরা ৩০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব করেছি। মালিক পক্ষ আমাদের বর্তমান মজুরির সঙ্গে আরও ১৪ টাকা যোগ করে মোট ১৩৪ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি। যেখানে গত তিন মাসে এক কেজি চালের দাম ১৫-২০ টাকা বেড়েছে, সেখানে ১৪ টাকা মজুরি বৃদ্ধি রশিকতা ছাড়া আর কী? তিনি আরও বলেন, আমরা শ্রমজীবী মানুষ, কাজ করতে চাই, আন্দোলন করতে চাই না। আমরা রাষ্ট্রের কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার দাবি করছি, কেন আমরা ন্যায্য মজুরি পাব না? দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার কর্মবিরতি পালন করব। এদিকে চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিসহ ন্যায্য দাবিসমূহ মেনে নিয়ে অবিলম্বে বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন ও সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব বুলবুল যৌথ বিবৃতিতে বলেন, চা শ্রমিকরা বছরে ৯ কোটি কেজির বেশি চা উৎপাদন করে যার খুচরা বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। একজন চা শ্রমিক দিনে তোলা ২৩ কেজি পাতা থেকে প্রায় ৬ কেজি চা উৎপাদন হয়। ২৩ কেজি পাতা তুলতে একজন চা শ্রমিককে মজুরি হিসাবে দেওয়া হয় মাত্র ১২০ টাকা, যা দিয়ে বর্তমান বাজারে একজন মানুষের খাবার সংগ্রহ করা যায় না। অথচ, একজন চা শ্রমিকের ওপর পরিবারের তিন থেকে চারজন সদস্য নির্ভরশীল। ৩০০ টাকা মজুরি পেলেও বর্তমান বাজারে ৪-৫ সদস্যের চা শ্রমিক পরিবারের জন্য খাদ্য বাবদ প্রয়োজনীয় ব্যয় পূরণ হওয়া কঠিন। আন্দোলনরত চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও ছুটি বৈষম্য দূরসহ ন্যায়সংগত দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে আজ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও মিছিলের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

সিলেট : গতকাল বেলা ১১টার দিকে নগরীর মালনিছড়া চা বাগানের মন্দিরের পাশে শ্রমিকরা জড়ো হন। পরে তারা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে মিছিল বের করেন। লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিকরাও মিছিলে যোগ দেন। মিছিলটি সিলেট বিমানবন্দর সড়ক হয়ে লাক্কাতুরা চা বাগানের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়।

কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) : গতকাল দুপুর ৩টার দিকে কুলাউড়া কালিটি, রাঙ্গিছড়া ও মুড়ইছড়াসহ ছয়টি চা বাগানের প্রায় সহস্রাধিক শ্রমিক ভুখা মিছিল নিয়ে ৭ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে যান। সেখানে শ্রমিকরা এক ঘণ্টা অবস্থান নিয়ে ৩০০ টাকা মজুরি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান।

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) : গতকাল শ্রমিকরা দেশের প্রতিটি চা বাগানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বলে জানান শ্রমিক নেতারা। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কুলাউড়ার ব্রাহ্মণবাজার চৌমুহনা ও নবীনচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে সড়ক অবরোধ করেন। এ ছাড়া শমশেননগর চৌমুহনা ও হবিগঞ্জের জগদীশপুর চৌমুহনার সড়ক আরোধ করে বিক্ষোভ করেন। উল্লেখ্য, গত শনিবার থেকে এই অনির্দিষ্টকালের শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়। ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে চা শিল্প। বন্ধ রয়েছে বাগানের কাঁচা পাতা তোলা ও চা কারখানার কাজসহ সব কাজকর্ম। বাগানে কাজ বন্ধ রেখে শ্রমিকরা দাবি আদায়ের আন্দোলন করে যাচ্ছেন।

হবিগঞ্জ : চা শ্রমিক নেতা ও শ্রম অধিদফতরের সঙ্গে সমঝোতা বৈঠকে কোনো ফল না আসায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণার মধ্যে হবিগঞ্জে মহাসড়ক অবরোধ করেছে শ্রমিকরা। মাধবপুর উপজেলার সুরমা ও তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের কয়েক হাজার শ্রমিক গতকাল বেলা ২টা থেকে পৌন এক ঘণ্টা মহাসড়কের জগদীশপুর মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে অবরোধ তৈরি করেন। পরে মাধবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ মঈনুল ইসলাম মঈন ও চুনারুঘাট মাধবপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহসিন আল মুরাদ ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের দাবি প্রধানমন্ত্রী বরাবর জানানোর আশ্বাস দিলে তারা অবরোধ তুলে নেন। এ সময় মহাসড়কের উভয় পাশে শত শত যানবাহনের দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর