শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

খুনিরাই ভর্তি করে হাসপাতালে

তদন্তে বেরিয়ে এলো ২০ আসামির কেউই জড়িত নয়

মাহবুব মমতাজী

খুনিরাই ভর্তি করে হাসপাতালে

মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান থেকে গুরুতর আহতাবস্থায় মিলন হাওলাদার (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওই ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাটি গত বছর ২৩ মার্চের। এ ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) পর সুরতহাল হয়। জিডি নম্বর-১৩৬৬। ওই দিনই মিলনের বড় বোন রেণু বেগম (৫০) সিরাজদীখান থানায় ২০ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন। থানা পুলিশ হয়ে মামলার তদন্ত চলে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)।

ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর সংস্থাটির তদন্তে বেরিয়ে আসে মামলায় অভিযুক্ত কেউই হত্যায় জড়িত নন। বরং যারা মিলনকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন তারাই হত্যার ঘটনা ঘটান। আর পথেই সিএনজিতে থাকাবস্থায় মিলনের গোপনাঙ্গে আঘাত করে মিলনের মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা। ৮ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ আদালতে মামলাটির অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক রাহাৎ খান।

সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে জানান, এজাহারে যাদের নাম ছিল ঘটনায় তাদের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে হত্যায় জড়িত তিনজনের নামে তারা আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে উল্লেখ করেছেন।

এজাহারে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল তারা হলেন- কামিজ উদ্দিন কামু, ফারুক হোসেন, আবুল হোসেন, রূপচান মিয়া, নুরুদ্দিন, রমজান, ইব্রাহীম, গিয়াস উদ্দিন, আলী আজর, আশাদ, জসিম, আলাউদ্দীন, মুল্লুক চান, রূপচান, আলম, নুরুজ্জামান ওরফে নুতা, খোরশেদ, আবুল, আনোয়ার হোসেন ও মহসিন।

এজাহারে যা বলা হয়েছে : ওই ২০ আসামি হত্যার উদ্দেশ্যে মিলনকে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকেন। এতে মিলনের চিৎকার শুনে রেণু বেগম, তার ভাগিনা দিদারসহ আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে এলে আসামিরা পালিয়ে যান। যাওয়ার সময় তারা মিলনের মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাদের টিনের ছাপরাঘরে আগুন লাগিয়ে দেন। তবে ভাগিনা দিদার ওই আসামিদের চিনতে পারে। পরে আহতাবস্থায় মিলনকে উদ্ধার করে প্রথমে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুরের স্বদেশ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওই দিন সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে মিলনকে মৃত ঘোষণা করেন। জানা যায়, এ ঘটনায় মামলা হলে প্রথমে তা তদন্ত করে সিরাজদীখান থানা পুলিশ। ওই সময় কামিজ উদ্দিন কামু, আবুল হোসেন, রূপচান মিয়া ও নুরুদ্দিনকে গ্রেফতারের পর আদালতে পাঠানো হয়। মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) আদিবুল ইসলাম মামলাটির তদন্ত তদারক করছিলেন। পুলিশ সদর দফতর হয়ে গত বছর ৩০ মে মামলার তদন্ত চলে আসে সিআইডিতে। এ সময় সংস্থাটির এসআই বিল্লাল হোসাইন মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। গত বছর ৪ জুলাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করে সিআইডির পরিদর্শক রাহাৎ খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্তে যা পায় সিআইডি : মিলন ঢাকায় সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করতেন। তার বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চাঁদনী হাওলাদার বাড়িতে। তিনি সামান্য বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যান। এর পর থেকে তিনি দীর্ঘদিন সিরাজদীখান উপজেলার পানিয়ারচর গ্রামে বোন নিলু ও ভগ্নিপতি বিল্লালের সঙ্গে বসবাস করে আসছিলেন। তাদের সঙ্গে রেণু বেগমও বসবাস করতেন। গত বছর ২২ মার্চ রাতে একটি নাটক সাজান মিলনের ভাগ্নে দিদার। দিদার বলেন, তার মামা মিলনকে মারধর করে তার থাকার ঘরে আগুন দিয়েছেন এজাহারে থাকা অভিযুক্তরা। মিলনের ঘরে ধোঁয়া দেখে তাকে উদ্ধার করেন প্রতিবেশীরা। মিলন সুস্থ থাকার পরও চিকিৎসার জন্য তাকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যান দিদার। হাসপাতালে নেওয়ার পথে রাস্তায় পানিয়ারচরে একটি বাড়িতে মিলনকে নাপা ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের সঙ্গে পর্যাপ্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়। এরপর দিদার ও আলাউদ্দি স্বদেশ হাসপাতালের উদ্দেশে সিএনজিতে করে রওনা করেন। সিএনজির ভিতর দিদার ও আলাউদ্দি তাদের মাঝখানে বসিয়ে গ্যাস লাইটারের আগুনে মিলনের চোখের ভ্রু পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে মিলনের পরনের গেঞ্জিও পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। পথে ডাইলার বাড়ির মোড়ে নেমে যান আলাউদ্দিন। এরপর স্বদেশ হাসপাতালে পৌঁছলে সেখানকার উপসহকারী মেডিকেল অফিসার ডা. আইনুল হক ও নার্স রিংকু বৌদ্ধ প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মিলনের কোনো সমস্যা নেই বলে জানান। এ ছাড়া পর্যাপ্ত ঘুম হলে মিলন পরিপূর্ণ সুস্থ হবেন বলেও পরামর্শ দেন। পরে মিলনকে নিয়ে স্বদেশ হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসেন দিদার। এরপর মিলনকে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলে কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুর হয়ে গোবিনপুর ও পোড়াহাটি গ্রামের নির্মাণাধীন রেলব্রিজ পার হয়ে আসেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী দিদারের সঙ্গে যোগ দেন আওলাদ। দুজনই মিলনকে হত্যা করতে তার কপালে, ডান চোখের ভ্রুতে, মাথায়, থুতনিতে, গলায়, বাঁ হাতের কনুইয়ে, ডান হাতের বাহুতে, পিঠের মেরুদন্ডের ওপর ও বাঁ পায়ের হাঁটুতে ব্যাপক মারধর করেন। এরপর মিলনকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মির্জাপুর মেইন রোডে কৃষ্ণার বাড়ির পুকুরের কাছে নিয়ে যান। মিলন প্রাণে বাঁচতে পুকুরে ঝাঁপ দেন। তখন দিদার পুকুরেই মিলনকে চুবিয়ে মারার চেষ্টা করেন। ভোরের আলো ফুটতে থাকলে আশপাশের লোকজন চলে আসায় দিদার বলতে থাকেন, ‘আমাদের ঘরে শত্রুরা আগুন দিছে। মামু ঘরে ছিল। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি মেন্টাল হওয়ায় পুকুরে দৌড় দিছে।’ স্থানীয়দের সহযোগিতায় মিলনকে পুকুর থেকে উদ্ধার করে একটি সিএনজিতে তুলে দিদার ও আওলাদ ঢামেকে রওনা দেন। তখন মিলন প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। পথে মিলনের গোপনাঙ্গে আঘাত করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন আওলাদ। এরপর তাকে ঢামেকের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়। পরে চলতি বছর সিআইডি মুন্সীগঞ্জ থেকে দিদারকে, কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর থেকে আলাউদ্দিনকে এবং রাজধানীর মালিবাগ থেকে আওলাদকে গ্রেফতার করে। যে কারণে হত্যা : দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের জেলখানার পেছনে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলায় ব্যবসা-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের লোকদের ফাঁসাতে এ হত্যার ঘটনা ঘটানো হয়।

 

সর্বশেষ খবর