শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

চা শ্রমিকের সন্তানের শিক্ষা ব্যয় দৈনিক ৮ পয়সা!

চা বোর্ডের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

শ্রমিকের মজুরি নিয়ে সরকারের কাছে পাঠানো বাংলাদেশ চা বোর্ডের (বিটিবি) প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা গেছে, একজন চা শ্রমিককে তার সন্তান বা পোষ্যদের শিক্ষাব্যয় হিসেবে প্রতিদিন ৮ পয়সা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও দৈনিক রেশন বাবদ ৩১ টাকা ৮ পয়সা, চিকিৎসা সুবিধা বাবদ ৮ টাকা ২২ পয়সা, ঘরভাড়া ৭৬ টাকা ৯২ পয়সা এবং অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকের পেনশন সুবিধা বাবদ ২ টাকা এবং দৈনিক ঝুঁকিভাতা হিসেবে ৪ থেকে ৬ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চা বোর্ডের এক প্রতিবেদনে শ্রমিকের দৈনিক মজুরি সম্পর্কে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে। চা বোর্ডের সদস্য (অর্থ ও বাণিজ্য) মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী গত ২৩ আগস্ট এ প্রতিবেদনটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠান।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, সরকারি চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের বিষয়টি নিয়ে চা বোর্ডের সঙ্গে কিছু আলোচনা হয়েছে। তারা শ্রমিকদের মজুরি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দিয়েছে, যেটি পরবর্তী নির্দেশনার জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।

প্রতিবেদনে, সরকারি চা বাগানে কর্মরত (অস্থায়ী) শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি দেখানো হয়েছে সর্বসাকুল্যে ৪১১ টাকা। এর মধ্যে দৃশ্যমান মজুরি বা নগদে হাতে দেওয়া হয় ১২০ টাকা। বাকিটা বিভিন্ন পণ্য বা সেবার মাধ্যমে ব্যয় হয়, যার মধ্যে শিক্ষা, চিকিৎসা, ঘরভাড়া, পেনশন, রেশন, উৎসব ভাতা, বার্ষিক ছুটি ভাতা, ধানখেতের জন্য ভূমি ইজারা ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ গরু চরানো এবং চৌকিদার ব্যয়, শ্রমিকদের জন্য ব্যবহৃত জমি বাবদ ভূমি উন্নয়ন কর, শ্রমিক কল্যাণ কর্মসূচি (গৃহ মেরামত, বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক স্প্রে, পয়ঃনিষ্কাশন, ছুপি-ছাতা, গাতি, গামছা, জ্বালানি কাঠ সরবরাহ) এমন কি বাসাবাড়িতে উৎপাদিত যে ফলমূল তার মূল্য এবং ভবিষ্য তহবিলের নিয়োগকৃত কর্তার ভাতা বাবদ কর্তৃপক্ষ যে ব্যয় করে সেগুলো টাকায় রূপান্তর করে দৈনিক মজুরিতে যুক্ত করা হয়েছে। এই সাকুল্য আয় ধরে হিসাব করলেও সরকারি বাগানে কর্মরত একজন চা শ্রমিকের মাসিক বেতনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ হাজার ৩৩০ টাকা, যা অন্য যে কোনো শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের মাসিক বেতনের তুলনায় কম। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবি ‘চাবাগানের কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকের অধিকার : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর। প্রকাশিত প্রতিবেদনে চা শ্রমিকের তখনকার দৈনিক মজুরি ১০২ টাকা এবং এর সঙ্গে প্রাপ্ত অন্যান্য সুবিধা যোগ করে টিআইবি দেখিয়েছিল যে, একজন শ্রমিকের মোট মাসিক সার্বিক মজুরি হয় ২০১৮ সালের পরিসংখ্যানমতে ৫ হাজার ২৩১ টাকা, যা ওই সময় সংশ্লিষ্ট অন্য সব খাতের মজুরির ভিতর সবচেয়ে কম।  টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১৮ সালে করা আমাদের ওই প্রতিবেদনের পর দৈনিক মজুরি বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে। সেই হিসাবে অন্যান্য সুবিধা ধরে চা শ্রমিকের মাসিক মজুরি ৫ হাজার টাকার চেয়ে কিছু বেশি হতে পারে। এটা কোনোভাবেই ১২ হাজার টাকা হবে না। চা বোর্ড যেসব সুবিধার ভিত্তিতে এই মজুরি দেখিয়েছে তার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি যেমন বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে, তেমনি অন্যান্য খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। তবে অন্য খাতে যে হারে বেড়েছে সে হারে বাড়েনি চা শ্রমিকদের। এ ছাড়া এখনকার দ্রব্যমূল্যের ভিত্তিতে চা শ্রমিকদের বর্তমান মজুরি দিয়ে ন্যূনতম মৌলিক সুবিধা লাভ করা যায় কি-না সেটিও বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলেন, চা শিল্প মালিকরা এখন হয়তো তাদের সাময়িক মুনাফা বিবেচনা করছেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়নের কথা চিন্তা করলে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সরকারি বাগানগুলোতে অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত শ্রমিকদের তারা যে মজুরি বা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন এটা বেসরকারি বাগানে কর্মরত শ্রমিকের প্রাপ্য সুবিধার চেয়ে বেশি। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য ব্যয় সম্পর্কে তিনি জানান, সরকারি চা বাগানগুলোর প্রতিটিতে প্রাইমারি স্কুল আছে। এই স্কুলগুলো পরিচালনায় ব্যয় রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওই ব্যয় টাকায় রূপান্তর করে শ্রমিকের দৈনিক মজুরিতে যুক্ত করা হয়েছে। একইভাবে চিকিৎসা বাবদ শ্রমিককে যে ওষুধপথ্য বা সেবা দেওয়া হয়- সেটিও টাকায় রূপান্তর করে দৈনিক মজুরিতে যুক্ত করা হয়েছে। চা বোর্ডের সদস্য জানান, তারা একজন শ্রমিককে প্রতি কেজি ২ টাকা দরে প্রতি সপ্তাহে ১০ কেজির কিছু বেশি এবং মাসে ৪০ কেজির বেশি চাল বা গম রেশন হিসেবে দেন। এ ছাড়া সরকারি বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য পাকা বাড়িও রয়েছে। দৈনিক মজুরিতে রেশন বাবদ ৩১ টাকা ৮ পয়সা ব্যয় দেখানো হয়েছে।

 

সর্বশেষ খবর