মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
চার শ বছরের প্রাচীন

নাগদরজার রাজবাড়ি

রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর

নাগদরজার রাজবাড়ি

চার শ বছরের প্রাচীন মোগল আমলের মধ্যযুগীয় স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন দিনাজপুরের ঐতিহাসিক ‘রাজবাড়ি’। হিন্দু, মুসলিম ও ইংরেজ- এ তিন যুগের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের বিচিত্র দৃষ্টিনন্দনের সমাবেশ এ রাজবাড়িটি। এ রাজবাড়িটিকে আরও সংস্কার ও পরিচ্ছন্নসহ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হলে এটি আরও পর্যটক এবং দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হবে। পরবর্তী প্রজন্মকে এর সঠিক ইতিহাস জানান দিতে এর রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি প্রয়োজন তথ্য সংরক্ষণও। উপমহাদেশ বিভাগের পর রাজবংশ উচ্ছেদ হয়। এর ফলে পরিত্যক্ত হয় এ রাজবাড়িও। রাজবাড়ির মূল বাড়িটি ৩০ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

সামন্তযুগীয় রাজবাড়িকে জড়িয়ে সত্য-মিথ্যা অনেক ঘটনা যেমন প্রচলিত আছে তেমনি রাজবাড়ির ক্ষেত্রেও আছে। এক সময় ছিল তখন পায়ে জুতা, মাথায় ছাতা এমনকি গায়ে জামা-কাপড় পরে সজ্জিত হয়ে কোনো প্রজার পক্ষে রাজবাড়ি ও গেটের সামনের পথ অতিক্রম করার মতো ধৃষ্টতা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ এ অপরাধ করলে তার প্রাপ্য ছিল পাইক-পেয়াদার হাতে জুতাপেটা বা লাঠি-গুতার পুরস্কার। এ ধরনের অনেক কথা শোনা যায়। ইতিহাসবিদ মেহরাব আলীর লেখা ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজবাড়ির প্রধান দরজাটির নাম নাগদরজা। এটি কৃষ্ণ পাথরে নির্মিত। দরজাটির চৌকাঠের উচ্চতা ৭ ফুট। এ উপমহাদেশে আর কোথাও সর্পমূর্তি দিয়ে এ ধরনের অদ্ভুদ ভাস্কর্যময় দরজা আছে বলে জানা যায়নি। বর্তমানে এটি ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। চারদিক থেকে সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা রাজবাড়ির অনেক প্রবেশদ্বার। এর মধ্যে ধর্মাদেউড়ী, সিংহ দেউড়ী, বেলতলীর দেউড়ী (নাট মন্দিরে যাওয়ার দ্বার), ঠাকুরবাড়ীর দেউড়ী, হাতিশালার দেউড়ী, হীরাবাগ দেউড়ী অন্যতম।

রাজবাড়ির প্রধানত দুটি অংশ-আয়নামহল ও রানিমহল। এ ছাড়া আছে ঠাকুরবাড়ি ও হীরাবাগ এলাকা। আয়না মহল দ্বিতল ভবন। এ ভবনের দোতলায় রাজ দরবার, জলসাঘর, মিছিলঘর, অতিথি ভবন, সভাকক্ষ ও নিচতলায় রাজকীয় পাঠাগার, কোষাগার ইত্যাদি। রাজা প্রাণনাথ ও রাজা রামনাথের আমলে আয়নামহল নির্মিত হয়। এ মহলের অধিকাংশ কক্ষ ভগ্নদশা। রানিমহলের চারদিকের ভগ্নমান প্রাচীরগুলো জরাজীর্ণ কিছু অস্তিত্ব ছাড়া সাবেক ভবন আর নেই। ত্রিশের দশকে তা ভেঙে ওই স্থানের ওপর আধুনিক ডিজাইনের দ্বিতল রানিভবন নির্মিত হয়। মূল প্রাসাদসহ বৃহত্তর রাজাবাড়ি প্রায় ১০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মূল বাড়ি থেকে একটি বিশেষ দূরত্বে গভীর পরিখার দ্বারা বেষ্টিত আউটার রাজবাড়ি এলাকার আয়তন ছিল তিন শ বিঘার মধ্যে। এ অংশে ম্যানেজার ভবনসহ উচ্চপদস্থ আমলা-কর্মচারীদের বাসাবাড়ি, রাজ অতিথি ভবন, পোস্ট অফিস, দাতব্য চিকিৎসালয়, আখড়া প্রভৃতি ছাড়াও কামার, ডোম, মেথরসহ পাইক-পেয়াদা, কোচোয়ান, দারোয়ান প্রমুখদের কলোনি ছিল। এরপরও রাজকীয় ফুলবাগান, সবজিবাগান এবং পদ্মসাগর, শুকসাগর, আনন্দসাগর, মাতাসাগর ও রামসাগর জাতীয় বৃহৎ দিঘি রয়েছে।

এ রাজবাড়িতে ১১ জনের মতো রাজা রাজত্ব করেন। এরা হচ্ছেন- শুকদেব, রামদেব, জয়দেব, প্রাণনাথ, রামনাথ, বৈদ্যনাথ, রাধানাথ, গোবিন্দনাথ, তারকানাথ, গিরিজিনাথ ও জগদীশনাথ। শেষ জগদীশনাথের এক ছেলে ছিলেন জলধিনাথ। প্রাসাদ ষড়যন্তের শিকার হয়ে ১৯৪১ সালে জলধিনাথ প্রাণ হারান। রাজগদিতে উপবেশন না করলেও এ রাজকুমারই ছিলেন রাজবংশের শেষ উত্তরাধিকারী।

বর্তমানে রাজবাড়ির ভিতরে রাজার আমল থেকেই কান্তজিউ মন্দিরে পূজা-পার্বণ চলে আসছে এবং আরেকটি অংশে এখন নিয়মিত দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। ভগ্নদশা এবং রাজবাড়ি এলাকায় বসতবাড়ি গড়ে ওঠায় সংকুচিত হয়ে আসছে এর পরিধি যা একদিন শুধু ইতিহাসই হয়ে থাকবে।

এ বিষয়ে দিনাজপুর প্রেস ক্লাব সভাপতি স্বরূপ বকশি বাচ্চুসহ স্থানীয়রা জানান, এ রাজবাড়ির পুরো এলাকাকে সংস্কার করে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হলে এ অঞ্চলে পর্যটকদের যেমন ভিড় বাড়বে তেমনি আজকের প্রজন্মের অনেকেই এ সম্পর্কে  আরও জানবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর