শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বদলে যাচ্ছে রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা

মতিঝিলের রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য ভবন এখন গুলশান-বনানীতে

জয়শ্রী ভাদুড়ী ও হাসান ইমন

বদলে যাচ্ছে রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা

নামে আবাসিক হলেও রাজধানীর বনানী এখন বদলে যাচ্ছে বাণিজ্যিক এলাকায় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর মতিঝিল-দিলকুশা এলাকা বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। একটা সময় ঢাকার প্রধানতম কমার্শিয়াল হাব ছিল এলাকাটি। অফিসপাড়া, ব্যাংকপাড়া বলতে তখন সবাই শুধু মতিঝিল এবং এর আশপাশের এলাকাকেই বুঝত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে। বর্ধিত ঢাকার নতুন বাণিজ্যিক কেন্দ্র বা কমার্শিয়াল হাব এখন গুলশান-১, গুলশান-২ এবং বনানী এলাকা। নামে আবাসিক হলেও বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় এখন এলাকাটিতে। রমরমা ব্যবসা-বাণিজ্য ঘিরে এলাকাটি এখন যানজট, অবৈধ গাড়ি পার্কিং, শব্দদূষণ, ময়লা-আবর্জনাসহ নানা সমস্যা জর্জরিত। এসব কারণে অতিষ্ঠ গুলশান আবাসিক এলাকার বাসিন্দারাও।

এ বিষয়ে গুলশান সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ইভা রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কোনোরকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এই এলাকায় দিন দিন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। স্কুল-কলেজ, বিপণিবিতান, রেস্টুরেন্ট, বিউটি পারলার, কোচিং সেন্টার, বার, গার্মেন্টসহ কী নেই গুলশান আবাসিক এলাকায়? যে যার ইচ্ছামতো বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন, আমরা গুলশান সোসাইটির পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা মৌখিকভাবে বিভিন্ন সময় বলে আসছি, কিন্তু কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি।

ইভা রহমান বলেন, পুরো গুলশান এলাকায় নতুন সমস্যা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। প্রভাবশালীরা একের পর এক বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিচ্ছেন। আবার কিছু ভবন বাণিজ্যিক হিসেবেও গড়ে উঠেছে। এসব ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক ভবনে প্রতিদিন হাজারো গাড়ি আসে। এতে বিভিন্ন সড়কে যেমন যানজট হচ্ছে তেমনি পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত পার্কিং সুবিধা নেই। ফলে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের সব গাড়ি পার্কিং করা হয় রাস্তায়। একই সঙ্গে ইচ্ছামতো গাড়ির হর্ন বাজানো হয়। সবসময় জমজমাট থাকে এ আবাসিক এলাকাটি। এসব কারণে অতিষ্ঠ আমরা। আর হারিয়ে যাচ্ছে আবাসিক এলাকার চিত্রও।

এ বিষয়ে নগর বিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১৫ বছর আগে ধানমন্ডি এলাকায় চারতলার ওপরে কোনো বাড়ি ছিল না। এখন ইচ্ছামতো উচ্চতায় দালানকোঠা তৈরি চলছে। ভাড়া দেওয়া হচ্ছে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে। ধানমন্ডি থেকেই এই বাণিজ্যিকীকরণের ভাইরাস নগরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেন, আস্তে আস্তে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। গুলশান-বনানী এলাকার নকশাতে বাণিজ্যিক প্রয়োজনের জন্য আলাদাভাবে নকশা করা আছে। অথচ আস্তে আস্তে ঘিঞ্জিতে পরিণত হতে থাকে পরিকল্পিত নকশায় গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকা গুলশান-বনানী। একে একে আবাসিক এলাকাগুলো হারিয়ে ফেলছে তার চরিত্র। আর এ জন্য ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এসব এলাকার বাসিন্দাদের।

আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিকে রূপান্তর করতে হলে কিছু পরিকল্পনা করতে হয় বলে জানান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একটি আবাসিক এলাকার জন্য যখন পরিকল্পনা করা হয় তখন আবাসিক এলাকা ও ট্রাফিকের চিন্তা করা হয়। পরে ওই চিন্তা থেকে এলাকা তৈরি করা হয়। কিন্তু আবাসিক এলাকা হওয়ার পর যখন বাণিজ্যিকে রূপান্তর হয়, তখন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আসে। বাণিজ্যিক স্থাপনায় মানুষের চলাচল বেড়ে যায়, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও সীমিত হয়ে পড়ে। ফলে একটি অঞ্চল তার বাসযোগ্যতা হারায়। নীতিনির্ধারক কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা-দুর্বলতায় বছরের পর বছর ধরে এসব অনিয়ম হয়ে আসছে। রাজধানী ঢাকার অন্যতম অভিজাত আবাসিক এলাকা হিসেবে একটা সময় পর্যন্ত পরিচিত ছিল গুলশান। ১৯৬১ সালে জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে পরিকল্পিত একটি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়েও উঠে। এরপর কূটনৈতিকপাড়া হিসেবেও পরিচিতি পায়। ফলে সে সময়ও গুলশান ও তার আশপাশের জমি ছিল তুলনামূলক মূল্যবান। এরপর বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি হতে শুরু করলে জমির দামও লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। হাতবদল ও বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগে জমির দাম বেড়েছে বহুগুণ, পাশাপাশি গুলশান হারিয়েছে অভিজাত আবাসিক এলাকার জৌলুসও। সময়ের ব্যবধানে সেই অভিজাত ছায়া সুনিবিড় আবাসিক ও কূটনৈতিক এলাকাটি বাণিজ্যিক স্থাপনার আড়ালে হারিয়েছে তার উপশহরের মর্যাদা। গুলশান ও এর আশপাশে এখন বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক ভবনের ছড়াছড়ি। এর কোনোটি আবাসিক প্লটকে রূপান্তর করে বাণিজ্যিক করা হয়েছে, আবার কোনো আবাসিক প্লটে অনুমতি ছাড়াই গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক ভবন। গার্মেন্ট, শিল্প-কলকারখানা, আবাসিক হোটেল, বিভিন্ন এজেন্সির অফিসসহ সারি সারি সুউচ্চ ভবনে শপিং মল, রেস্টুরেন্ট মিলিয়ে একসময়ের শান্ত-স্নিগ্ধ সবুজ অভিজাত আবাসিক এলাকা তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। একই অবস্থা বনানী আবাসিক এলাকার। বনানী বাজারের আশপাশের বিভিন্ন সড়কেই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে বেশি। এর বেশির ভাগই চলছে আবাসিক প্লটে। বনানীর ৬ নম্বর সড়ক, ১২ নম্বর সড়ক, ১২/এ সড়ক, ১৩/এ সড়ক, ১৩/বি নম্বর সড়ক, ১৩/সি সড়ক, ১৩/ই সড়ক, ১৫ নম্বর সড়ক, ১৭ নম্বর সড়ক, ২১ নম্বর সড়ক, ২২ নম্বর সড়ক, ২৭ নম্বর সড়ক, ২৮ নম্বর সড়কে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল, হেলথ সেন্টার, মেডিকেল সার্ভিস, রেস্তোরাঁসহ নানান বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর