শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

কাল্পনিক আসামি

মাহবুব মমতাজী

কাল্পনিক আসামি

অস্ত্র মামলায় প্রকৃত অভিযুক্তকে রেহাই দিতে আরেকজনকে কাল্পনিক আসামি বানানো হয়। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর রাজবাড়ী সদর থানায় করা একটি অস্ত্র মামলায় এ ঘটনা ঘটে। ওই মামলার নম্বর-৫। মামলাটির প্রাথমিক তথ্য বিবরণী, জব্দ তালিকা ও অভিযোগপত্রের জাবেদা নকল জাল-জালিয়াতি করা হয়। জালিয়াতির পর রাজবাড়ী সদর থানার অস্ত্র মামলায় এক নম্বর আসামি দেখানো হয় শাহীনুর রহমান ওরফে শাহীন ওরফে কালা শাহীন। অথচ এই ব্যক্তির কোনো অস্তিত্বই নেই।

নিজেদের সুবিধামতো কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি করে ২০১৬ সালের ২৭ জুলাই উচ্চ আদালত থেকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নেন ইয়ার আলী ওরফে ইয়াদ আলী ওরফে খোরশেদ ওরফে বিল্লাল। সে সময়ের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ আহমেদ মামলার মূল কাগজপত্র রাজবাড়ী সদর থানা থেকে সংগ্রহ করে আদালতের নজরে আনলে জাল-জালিয়াতি করে কাল্পনিক আসামি বানানোর বিষয়টি প্রকাশ পায়। এ ঘটনায় হাই কোর্টের তৎকালীন সহকারী রেজিস্ট্রার (বর্তমানে ডেপুটি রেজিস্ট্রার, ফৌজদারি-১) সিদ্দিকুর রহমান ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর-১৮। আসামি করা হয় অ্যাডভোকেট মুসরোজ ঝর্ণা সাথী এবং তদবিরকারক শাহিনুর রহমানকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথমে মামলাটির তদন্ত করেন শাহবাগ থানার এসআই আবদুল মোত্তালেব। তিনি অ্যাডভোকেট মুসরোজ ঝর্ণা সাথীকে অভিযুক্ত করে ২০১৭ সালের ৬ জুলাই আদালতে চার্জশিট দেন। এদিকে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিয়েছেন মুসরোজ ঝর্ণা সাথী। পরে আদালত ওই চার্জশিট পর্যালোচনা করে অধিকতর তদন্তের জন্য মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠায়। ২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন সিআইডির এসআই আসাদুর রহমান। পরে তিনি অন্যত্র বদলি হলে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল মামলাটির তদন্ত শুরু করেন অপর এসআই জাকির হোসেন। তিনি গত বছরের ১০ মার্চ মামলাটির চার্জশিট দাখিল করেছেন। তার তদন্তে এই জাল-জালিয়াতিতে অ্যাডভোকেট সাথী ছাড়াও আরও ছয়জনের নাম বেরিয়ে এসেছে। তারা হলেন- উচ্চ আদালতের আইনজীবীর সহকারী হারুন অর রশীদ, মাজেদুল ইসলাম, রংপুর জজ কোর্টের আইনজীবীর সহকারী দেলোয়ার হোসেন ওরফে নুর আলম, এবিএম রায়হান চৌধুরী, আবুল হোসেন এবং রংপুর পীরগাছার কম্পিউটার দোকানদার শামীম রেজা। এদের মধ্যে আবুল হোসেন পলাতক বলে জানা গেছে। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জাকির হোসেন জানান, এদের মধ্যে একজনকে ঢাকা থেকে, আরেকজনকে নারায়ণগঞ্জ থেকে এবং বাকি তিনজনকে রংপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিআইডির তদন্তে দেখা গেছে, তদন্ত কর্মকর্তা জব্দ হওয়া একটি চিঠির খামের সূত্র ধরে কাজ শুরু করেন। খামটি পর্যালোচনা করে দেখেন রংপুর থেকে নুর আলম এসএ পরিবহনের মাধ্যমে ওই খামের ভিতরে কিছু কাগজপত্র উচ্চ আদালতে হারুনের কাছে পাঠান। নুর আলমের প্রকৃত নাম দেলোয়ার হোসেন। হারুনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে রংপুরের আইনজীবীর সহকারী দেলোয়ার এবং উচ্চ আদালতের আইনজীবীর সহকারী মাজেদুল ইসলামের নাম বেরিয়ে আসে। ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রংপুর থেকে দেলোয়ারকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে রায়হান এবং শামীম রেজার নাম বেরিয়ে আসে। পরে তাদের রংপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে আদালতের বিভিন্ন দফতরের জজ কোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, ডেপুটি জেলার এবং উচ্চ আদালতসহ থানার বিভিন্ন ধরনের সিল জব্দ করা হয়। হারুনের তথ্যানুযায়ী নারায়ণগঞ্জ থেকে মাজেদুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। মাজেদুলের জবানবন্দিতে সাফায়েত নামে একজন জেল পুলিশের নাম পাওয়া যায়। তবে তদন্ত করে তার কোনো সঠিক নাম-ঠিকানা পাননি তদন্ত কর্মকর্তা। হারুন অর রশিদের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে। তিনি ১৯৯৪ সালে খালিশপুর পিপলস জুট মিলস মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০১০ সালে উচ্চ আদালতে আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। কাজ করার সময় অপর আইনজীবীর সহকারী মাজেদুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয়। মাজেদুলের মাধ্যমে রংপুরের দেলোয়ারের সঙ্গে পরিচয় হয়। দেলোয়ার রংপুর জজ কোর্টে আইনজীবীর সহকারী হিসেবে কাজ করার সময় আবুল হোসেন এবং রায়হানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আবুল হোসেন তাকে জাল-জালিয়াতির পদ্ধতি শেখান। তারা তিনজনে রংপুর কোর্টের মামলাসমূহ জামিনের জন্য উচ্চ আদালতের আইনজীবীর সহকারী মাজেদুল, রাকিব ও সজলদের কাছে পাঠাতেন। এরা উচ্চ আদালত থেকে আসামিদের জামিন করাতেন। এদিকে রাজবাড়ী সদর থানার অস্ত্র আইনে করা মামলাটির আসামি ইয়ার আলী ওরফে ইয়াদ আলী ওরফে খোরশেদ ওরফে বিল্লালের উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদনটি দেখাশোনা করছিলেন মাজেদুল। যেহেতু এই মামলায় জামিনের কোনো উপায় ছিল না। তাই মাজেদুল ফোনে দেলোয়ারকে রাজবাড়ী সদর থানার মামলার এজাহার, জব্দ তালিকা ও চার্জশিট জালিয়াতি করে দিতে বলেন। মাজেদুল তাকে বলেন, একজন আসামির স্থলে দুজন আসামিকে ঢোকাতে হবে। এতে ৩০ হাজার টাকার চুক্তি। মাজেদুল দেলোয়ারের কাছে কাগজপত্র পাঠান। আবুল হোসেন ও রায়হানকে সঙ্গে নিয়ে কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখেন দেলোয়ার। পাঠানো কাগজপত্রে ইয়ার আলীর কাছ থেকে একটি রাইফেল ও গুলি জব্দ দেখানো ছিল। তারা তিনজন মিলে শামীমের কম্পিউটারের দোকানে এজাহার, জব্দ তালিকা ও চার্জশিট জালিয়াতি করে ইয়ার আলীর পরিবর্তে কাল্পনিক শাহিন মিয়া ওরফে শাহিন ওরফে শাহিনকে ১ নম্বর আসামি বানানো হয়। আর ইয়ার আলীকে ২ নম্বর আসামি বানানো হয়। অস্ত্র ও গুলি জব্দ দেখানো হয় ১ নম্বর আসামি শাহিনের কাছ থেকে। জালিয়াতি করে ইয়ার আলীর কাছ থেকে কোনো কিছু জব্দ দেখানো হয়নি। এরপর সেসব কাগজপত্রের জাল জাবেদা তৈরি করা হয়। পরে মাজেদুল তাদের ফোন করে ওইসব কাগজপত্র হারুনের ঠিকানায় পাঠাতে বলেন। দেলোয়ার কাগজপত্রের সঙ্গে হারুনের কাছে ৫০ হাজার টাকাও পাঠান। এসব কাগজপত্রের ওপর ভিত্তি করে হারুন অ্যাডভোকেট সাথীর মাধ্যমে ইয়ার আলীর জামিন করান। এ মামলা ছাড়াও দেলোয়ার আরও ৬-৭টি মামলার কাগজপত্র জাল-জালিয়াতি করেছিলেন। সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাজেদুল ইয়ার আলীর জামিনের কাজটি পেয়েছিলেন তৎকালীন ঝিনাইদহ জেলের জেল পুলিশ সাফায়েতের মাধ্যমে। এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে এপিবিএনে বদলি হওয়া) কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, জামিন নিয়ে জাল-জালিয়াতির বিষয়টি তারা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করেছেন। সারা দেশের রংপুর, গাইবান্ধা, সিলেট এবং খুলনা অঞ্চলের চক্রগুলো তারা চিহ্নিত করেছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর