সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

চাল প্রতারণা বন্ধে হচ্ছে আইন

বস্তায়ও লিখতে হবে ধানের নাম, মিনিকেটসহ কাল্পনিক নাম লিখলে হবে শাস্তি

উবায়দুল্লাহ বাদল

চাল প্রতারণা বন্ধে হচ্ছে আইন

দেশের বাজারে সয়লাব হয়ে আছে মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাজল নামের চাল। অথচ এসব নামের কোনো ধান নেই বাস্তবে। এ নামের ধান যেমন দেশের কোথাও আবাদ হয় না, তেমনি কেউ আমদানিও করেন না। তারপরও বাজারে মিনিকেট, কাজল ও নাজিরশাইল নামের চালের ছড়াছড়ি। কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, মূলত দেশে উৎপাদিত ‘ব্রি-২৮’ ও ‘ব্রি-২৯’ ধানকে মিক্স ও ওভারপলিশ করে বাজারজাত করছে মিল মালিকরা। করা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং। এই প্রতারণা বন্ধে আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। এমতাবস্থায় প্রতিটি ধানের নামে চালের ব্র্যান্ডিং করতে নতুন আইন করছে সরকার। এটি কার্যকর হলে মিনিকেটসহ কাল্পনিক ধানের নামে চাল বাজারজাত করলে সংশ্লিষ্ট মিলারকে শাস্তির মুখে পড়তে হবে।

এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘মিনিকেট নামে দেশে কোনো ধান নেই। অথচ কুষ্টিয়া, নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়াসহ রাজধানীর চালের বাজারগুলো মিনিকেট চালে সয়লাব। মিলাররা অস্তিত্বহীন ধানের নামে চাল বাজারজাত করে ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা করছেন। এটি বন্ধ করতে নতুন আইন করছে সরকার। শিগগিরই তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী চালের বস্তার গায়ে উৎপাদিত ধানের জাতের নাম, উৎপাদন তারিখ, বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম এবং কি পরিমাণে ছাঁটাই করা হয়েছে তার তথ্য লেখা থাকতে হবে। এটি কার্যকর হলে যারাই মিনিকেটসহ অস্তিত্বহীন ধানের নামে চাল বাজারজাত করবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনা হবে।’ গত রবিবার বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ ও প্রচলিত ধারণা আছে, মোটা চাল কেটে চিকন করে বেশি দামে বিক্রি করে প্রতারণা করা হচ্ছে। এই প্রতারণা রোধে বাজারে থাকা চালের উৎস ও ধানের জাত নির্ণয়ের উদ্যোগ নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রচুর ধান উৎপাদন হয়- এমন ২১ জেলায় সমীক্ষা চালায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এফপিএমইউ ইউনিটের ১৩ কর্মকর্তা। গত বছরের জুনে তারা এই সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেন। এতে বলা হয়, আধুনিক প্রযুক্তিগুণে ‘ব্রি-২৮’ ও ‘ব্রি-২৯’ ধানের চালই বাজারে ধুমছে বিক্রি হচ্ছে এসব নামে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে একই চাল ভিন্ন ভিন্ন নামে বস্তাবন্দি হচ্ছে। যে চাল কুষ্টিয়ায় ‘নাজিরশাইল’, ওই চালই বগুড়ায় ‘মিনিকেট’ এবং শেরপুরে ‘কাজল’ নামে বস্তাবন্দি হচ্ছে ভিন্ন কোম্পানির ব্র্যান্ডে। তবে মোটা চাল কেটে চিকন করা হচ্ছে, এমন অভিযোগের সত্যতা মেলেনি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশে বোরো ও আমন মৌসুমে ব্যাপকভাবে চাষ হয় ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ ধান। কিন্তু বাজারে এই নামে চাল নেই। পাওয়া যাচ্ছে মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে। কিন্তু এই নামে ধানের কোনো জাত নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্রি-২৮ ও কিছু ক্ষেত্রে ব্রি-২৯ ধান কারসাজি করে ‘মিনিকেট’ নামে বাজারজাত করা হয়। একইভাবে ব্রি-২৯ ধান অধিক ছাঁটাই ও পলিশ করে চালের নাম দেওয়া হয় ‘নাজিরশাইল’। ‘নাইজার শাইল’ নামে এক ধরনের ধান স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হলেও তা পরিমাণে খুবই কম, যা বাজারে সচরাচর মেলে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘মিনিকেট ও নাজিরশাইলের নামে বাজারে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে তা আদতে ‘ব্রি-২৮’ ও ‘ব্রি-২৯’ ধানের চাল।’ এই প্রতারণা বন্ধে আইন করার তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘মেশিনে চাল পলিশিং করে আকর্ষণীয় করে মিল মালিকরা প্রতারণা করছেন। চাল পলিশিং করে মিলগুলো চাল চিকন করে। এতে চালের পুষ্টিগুণ অনেক কমে যায়। অগ্রসরমান অর্থনীতিতে এমন প্রতারণা মানা যায় না। চালের জাতের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে মিলগুলো ব্র্যান্ড দাঁড় করিয়ে প্রতারণা করছেন। এটি আইন করে বন্ধ করা উচিত।’ গত ৮ জানুয়ারি একটি গণমাধ্যম আয়োজিত ‘বায়োফর্টিফায়েড জিঙ্কসমৃদ্ধ ব্রি ধানের বাজার সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফলিত গবেষণা বিভাগের প্রধান ড. মো. হুমায়ুন কবীর বলছেন, বাংলাদেশে মিনিকেট জাতের ধানও নেই, চালও নেই। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আজ পর্যন্ত এই জাতের ধান উদ্ভাবনও করেনি। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও মিনিকেট জাতের ধান নেই। তবে ভারত সরকারের কৃষিবিভাগ ধান উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সে দেশের চাষিদের মাঝে সার, কীটনাশকসহ বিভিন্ন উপকরণের প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়। তারা সেটিকে ‘মিনিকিট’ বলে। ওই মিনিকিটকে পুঁজি করে হয়তো বাংলাদেশে মিনিকেট শব্দটা প্রচলন করেছেন অসাধু চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা।

সর্বশেষ খবর