মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
করতোয়া পাড়ে কান্নার রোল

সাতপাকের মেহেদি আর হলুদের চিহ্ন রেখে মুছে গেল নববধূর স্বপ্ন

পঞ্চগড় প্রতিনিধি

সাতপাকের মেহেদি আর হলুদের চিহ্ন রেখে মুছে গেল নববধূর স্বপ্ন

এখনো হলুদের গন্ধ শরীর থেকে যায়নি। মুছে যায়নি মেহেদির দাগ। দেড় মাস আগে হিমালয় আর বন্যা সাতপাকের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। জীবনের বাকি সময়টা একসঙ্গে কাটানোর স্বপ্ন নিয়ে পূজা উৎসবে মেতেছিলেন দুজনে। গত রবিবার তারা দুজনে মহালয়ার ধর্মসভায় যোগ দেওয়ার জন্য বদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন। করতোয়ার পানিতে স্নান করে পাপমুক্তির আশা ছিল তাদের। কিন্তু সেই করতোয়াই স্বামীর জীবন কেড়ে নিয়েছে। নৌকাডুবিতে সব স্বপ্নের ঘটেছে সমাপ্তি। বোদা উপজেলার ময়দানদীঘি খালপাড়া গ্রামের নবদম্পতি হিমালয় চন্দ্র ও বন্যা বোদেশ্বরী মন্দির দর্শনের উদ্দেশে যাওয়ার সময় নৌকা ডুবে নিখোঁজ হয়ে গেছেন স্বামী হিমালয়। উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে নিজের কাপড় খুলে প্রাণে বেঁচেছেন বন্যা। কিন্তু আঁকড়ে রাখতে পারেননি স্বামীকে। তাদের সঙ্গে থাকা হিমালয়ের মামাতো বোন আঁখিরও খোঁজ মেলেনি। হিমালয়ের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, দেড় মাস আগে ওই গ্রামের বীরেন্দ্রনাথ-সারদা রানী দম্পতির ছেলে হিমালয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বন্যার। ঘটনার দিন খুব আনন্দে সেজে বের হয়েছিলেন বন্যা-হিমালয়। ফিরে এসে পূজার কেনাকাটা করার কথা ছিল তাদের।

রক্ষা পাননি লিপি রানীরাও : দেবীগঞ্জ উপজেলার ছত্র শিকারপুর গ্রামের লিপি রানী (৩০) পরিবারের আরও তিনজনকে নিয়ে উঠে বসেন নৌকায়। ইচ্ছে ছিল বাবা মায়ের জন্য তর্পণ করবেন মন্দিরে। কিন্তু মন্দিরে পৌঁছানো তো দূরের কথা, নদীই পার হতে পারেননি তারা। নৌকার অন্যান্য যাত্রীর মতো একসঙ্গে প্রাণ যায় এই চারজনেরও। লিপি রানী রবিন বর্মণের স্ত্রী। লিপি রানীর সঙ্গে ছিলেন তার চার বছর বয়সী ছেলে বিষ্ণু বর্মণ, রবিনের ছোট ভাই কার্তিক বর্মণের স্ত্রী লক্ষ্মী রানী (২৫) এবং রবিনের ভাতিজা তিন বছর বয়সী শিশু দীপঙ্কর বর্মণ।

ওইদিন রাতে উদ্ধার হওয়া চারজনের লাশ সৎকার করতে গতকাল সকালে শ্মশানে নিয়ে গেছেন পরিবারের লোকজন। একই পরিবারের চারজনের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে ওই পরিবারে। স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়ে নির্বাক রবিন। ছেলেকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন রবিনের ছোট ভাই বাবুল বর্মণ।

বাবুল বর্মণ বলেন, আমার তিন বছর বয়সী একমাত্র ছেলে দীপঙ্করকে আমার বৌদিদের সঙ্গে মন্দিরে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু কে জানত সে লাশ হয়ে ফিরবে। নিহত লিপির স্বামী রবিন বর্মণ বলেন, নৌকাডুবিতে আমার সব শেষ হয়ে গেল।

একটি সেতুর দাবি ছিল দীর্ঘদিনের : সেতু না থাকায় বোদা উপজেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে বড়শশী ও কাজলদীঘি কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়ন। এ দুটি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে করতোয়া ও ঘোড়ামাড়া নদী। করতোয়া ও ঘোড়ামাড়া নদীর মিলনস্থলেই আউলিয়া ঘাট। ঘাট পার হলেই ঐতিহাসিক বদেশ্বরী মন্দির। প্রতিবছর মহালয়ার দিনে এই মন্দিরে ধর্মসভা বসে। সনাতন ধর্মাবলম্বী হাজার হাজার  মানুষ এই দিনে ছুটে আসেন মন্দিরে। মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা কয়েকটি থাকলেও দূরত্বের কারণে পূজারিরা এই ঘাট দিয়েই যাতায়াত করেন। মন্দিরে তারা তর্পণ-অর্পণের মাধ্যমে পিতা মাতার মঙ্গল কামনা করেন।

এই দুটি ইউনিয়নের মানুষকে আউলিয়া ঘাটে ডিঙি নৌকা কিংবা বাঁশের সাঁকো দিয়ে প্রতিদিন যেতে হয় বোদা উপজেলা সদরে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও এভাবেই পারাপার হতে হয়। শুষ্ক মৌসুমে বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপার করতে হয়। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস কিংবা উপজেলা প্রশাসনের কোনো গাড়ি বিশেষ বিশেষ কাজে ওই এলাকায় যাওয়ার প্রয়োজন হলে পঞ্চগড় জেলা শহর দিয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ ঘুরে যেতে হয়। আউলিয়ার ঘাটে নদী পারাপার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভোগান্তিতে ছিলেন ওই এলাকার মানুষ। তাই তারা সেখানে একটি সেতু নির্মাণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সর্বশেষ ২০২১ সালে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সরকারের রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ঘাটটি পরিদর্শন করেন। তিনি জনগণের দাবির মুখে একটি সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ঘোষণার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেতু নির্মাণের কোনো কার্যক্রম বা তৎপরতা সেখানে চোখে পড়েনি এই এলাকার মানুষের।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর