রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা
ইউএনওকে হাতুড়িপেটার রায় ৪ অক্টোবর

ক্ষোভ থেকে হামলা করেন রবিউল

মাহবুব মমতাজী

১৬ হাজার টাকা চুরির অভিযোগে ৫০ হাজার টাকা আদায় করায় দিনাজপুরে ঘোড়াঘাটের সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন তারই বাগানের মালী রবিউল ইসলাম। ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলী শেখ হত্যাচেষ্টা মামলার বিচারকাজ ৬১ কার্যদিবস চলার পর ৪ অক্টোবর রায় ঘোষণা করা হবে।

সূত্র জানিয়েছে, ২৭ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-৩ আদালতের বিচারক শ্যাম সুন্দর রায়।

আদালত ও তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাতে ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদের বরখাস্ত মালী রবিউল ইসলাম (৩৫) তৎকালীন ইউএনও ওয়াহিদা খানমের সরকারি বাসভবনে প্রবেশ করে হাতুড়ি দিয়ে তাকে ও তার বাবা ওমর আলী শেখকে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় ৩ সেপ্টেম্বর ওয়াহিদার ভাই শেখ ফরিদ বাদী হয়ে ঘোড়াঘাট থানায় একটি মামলা করেন। ডিবি পুলিশ তদন্ত করে ১১ সেপ্টেম্বর ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের বরখাস্ত মালী দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ভীমরুল গ্রামের রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করে। ওই বছর ২০ সেপ্টেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রবিউল। তার জবানবন্দির ভিত্তিতে ২১ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তৎকালীন ডিবির পরিদর্শক ইমাম জাফর। ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলায় রবিউলের বাইরে আর কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।

জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল বলেছেন, তিনি জেলা প্রশাসকের বাসভবনে মালী হিসেবে কাজ করতেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তাকে ঘোড়াঘাট উপজেলায় বদলি করা হয়। ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে তিনি ১৬ হাজার টাকা চুরি করেছিলেন। বিষয়টি ধরা পড়ার পর ইউএনওকে তিনি ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন, যাতে তার চাকরি নিয়ে কোনো সমস্যা না হয়। ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ইউএনও তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না বলে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ জানুয়ারি ইউএনও টাকা চুরির বিষয়টি উল্লেখ করে রবিউলের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেন। ৫ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ কারণেই তিনি ইউএনওর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইউএনওর বাসভবনের সাবেক মালি রবিউল ইসলামের বাড়ি বিরল উপজেলার ভীমরুল গ্রামে। আগের দিন সকালে সাইকেল চালিয়ে তিনি দিনাজপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যান। সেখানে কাজ শেষ করে বেলা ১১টার দিকে শহরের ষষ্ঠীতলা মোড়ে মুরাদের সেলুনে যান। সেখানে দীর্ঘ সময় তিনি মোবাইলে গেম খেলেন। বেলা দেড়টার দিকে মুরাদের কাছে ১০০ টাকা ধার চান রবিউল। কিন্তু মুরাদ টাকা ধার দেননি। রবিউল এ সময় মুরাদকে বিশেষ কাজে বাইরে যাওয়ার কথা বলে তার দোকানে সাইকেলটা রাখতে চান। মুরাদ তার দোকানে সাইকেল রাখার ব্যবস্থা নেই জানিয়ে পাশের আইনুলের গ্যারেজে সাইকেল রাখতে বলেন। রবিউল এ সময় সাইকেল নিয়ে আইনুলের গ্যারেজে রাখেন। বিশেষ কাজে বাইরে যাওয়ার কথা বলে রাতে নাও ফিরতে পারেন বলে জানান রবিউল। আইনুল সাইকেল রাখার জন্য দিনে ১০ টাকা এবং রাতে ১৫ টাকা দিতে হবে জানালে রবিউল তাতে রাজি হন। বেলা ৩টার দিকে শহরের ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে যান রবিউল। সেখান থেকে তৃপ্তি পরিবহনে উঠে ঘোড়াঘাটের রানীগঞ্জ বাজার বাসস্ট্যান্ডে নামেন। সেখান থেকে ওসমানপুর উপজেলা চত্বরের বাইরে রাত ১টা পর্যন্ত ঘোরাফেরা করেন রবিউল। পরে পুরাতন মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়াল টপকে উপজেলা পরিষদ চত্বরে প্রবেশ করেন।

উপজেলা পরিষদের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে সূত্র জানায়, রাত ১টা ১৯ মিনিটে রবিউল গার্ডরুমের সামনে দারোয়ান আছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর উপজেলার সরকারি কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে ইউএনওর বাসভবনের পশ্চিম দিকের দেয়াল টপকে বাসভবন চত্বরে প্রবেশ করেন। সেখানে কিছুক্ষণ বাসভবন পর্যবেক্ষণ করার পর রাত ১টা ৪৬ মিনিটে বাসভবনের পেছনের কবুতরের ঘরের দিক থেকে একটি মই হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে আসেন। ২টা ২ মিনিটে তিনি একটি হাতুড়িসহ গোলঘরে গিয়ে একটি চেয়ার নিয়ে যান। চেয়ার ও মই দিয়ে তিনি বাসভবনের দ্বিতীয় তলায় উঠতে গিয়ে ব্যর্থ হন। রাত ২টা ২৬ মিনিটে তাকে চেয়ারটি পুনরায় গোলঘরে ও মইটি বাসভবনের পশ্চিম দিকে রেখে আসতে দেখা যায়। এরপর ২টা ৩৬ মিনিটে রবিউলকে খালি হাতে গোলঘরের দিকে গিয়ে আবার ফেরত এসে বাসভবনের বাইরের সিকিউরিটি লাইট বন্ধ করতে দেখা গেছে। সিসিটিভি ক্যামেরায় তখন রাত ৩টা ২৯ মিনিট। তাকে আবার আম গাছের নিচ থেকে মই ও ব্যাগ নিয়ে বাসভবনের দিকে যেতে দেখা যায়। ৩টা ৩৬ মিনিটে চেয়ার ও টুল একসঙ্গে করে মই বেয়ে তিনি দ্বিতীয় দফায় ইউএনওর বাসভবনের দ্বিতীয় তলার বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেন।

জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল বলেছেন, বাথরুমে ঢোকার পর তিনি বুঝতে পারেন বেডরুমের ভিতর থেকে বাথরুমের ছিটকিনি আটকানো। ধাক্কা দিয়ে তিনি ছিটকিনি ভেঙে বেডরুমে প্রবেশ করেন। এর মধ্যে শব্দ পেয়ে ইউএনও তার বাবাকে ডাক দেন। রবিউল সঙ্গে সঙ্গে ইউএনওর মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। ইউএনও ওয়াহিদা অচেতন হয়ে পড়ে যাওয়ার পর তার বাবা সেখানে আসেন। রবিউল তাকেও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে মেঝেতে ফেলে দেন। পরে ওয়্যারড্রোবের ওপরে রাখা ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ভ্যানিটি ব্যাগে থাকা ৫০ হাজার টাকার একটি বান্ডিল নেন তিনি। এ সময় ফজরের নামাজের আজান শুরু হলে তিনি দ্রুত ভেন্টিলেটর দিয়ে বের হয়ে চলে যান। সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা গেছে, রাত ৪টা ৩১ মিনিটে মই ও ব্যাগ নিয়ে আম গাছের দিকে যাচ্ছেন রবিউল। রাত ৪টা ৪১ মিনিটে উপজেলার মেইন গেটের দিকে তাকে লাঠি হাতে যেতে দেখা যায়। ইউএনওর বাসা থেকে বের হয়ে তিনি নতুন ভূমি অফিস-সংলগ্ন পুকুরে হাতুড়িটি ফেলে দেন। হেঁটে হেঁটে তিনি ঘোড়াঘাট টিঅ্যান্ডটি মোড়ে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। এ সময় হানিফ পরিবহনের ঢাকাগামী একটি বাস এলে তাতে উঠে বিরামপুরে গিয়ে নামেন। বিরামপুর শহরের ঢাকা মোড়ের একটি গলিতে গিয়ে গাছের নিচে হাতে থাকা লাল প্লাস্টিকের ব্যাগ এবং ব্যাগে থাকা লাল শার্ট, লাল গামছা, মাংকি ক্যাপ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন তিনি। বিরামপুর বাজারে গিয়ে একটি হোটেলে ৩০ টাকা দিয়ে খিচুড়ি খান। পরে সেখান থেকে একটি পিকআপে করে দিনাজপুর শহরে যান। এরপর ষষ্ঠীতলার আইনুলের গ্যারেজ থেকে সাইকেল নিয়ে সোজা চলে যান বিরলের নিজ বাড়িতে। বাড়িতে গিয়ে গোসল করে ভাত খেয়ে সাইকেল নিয়ে আবারও দিনাজপুরে ডিসি কার্যালয়ে যান। পরে গোর-এ শহীদ ময়দানের পাশে কালেক্টরেট স্কুলের সামনে গিয়ে খোকন নামে একজনকে ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা দেন রবিউল।

খোকন, সেলুন মালিক মুরাদ ও গ্যারেজ মালিক আইনুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা রবিউলের স্বীকারোক্তির সঙ্গে মিল পেয়েছেন। পরে তিনজনকেই এ মামলার সাক্ষী করা হয়।

সর্বশেষ খবর