বৃহস্পতিবার, ৩ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বিমানের প্রশ্নফাঁসে শীর্ষ কর্মকর্তারা

পরিচালক প্রশাসনের কক্ষ থেকে হয় ফাঁস

সাখাওয়াত কাওসার

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালক প্রশাসনের কক্ষেই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। সেই কক্ষেই ফটোকপি মেশিনে প্রশ্নপত্রের ফটোকপি করার সময় প্রশ্নপত্রের ছবি তোলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) এমএলএসএস জাহিদ হাসান। পরে  সেগুলো বিভিন্ন ক্লায়েন্টের কাছে বিক্রি করা হয়। ফটোকপি করার সময় ওই কক্ষে বিমানের তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। বিমান এয়ারলাইনসের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত ১০ জনের মধ্যে এরই মধ্যে ৯ জন অপরাধ কবুল করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের জবানিতে উঠে এসেছে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে বিমানের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাই জড়িত। ৯ জনের জবানবন্দিতে উঠে আসা চাঞ্চল্যকর তথ্যের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আদালতসহ একাধিক সূত্র।

গত ২১ অক্টোবর শুক্রবার বেলা ৩টায় বিমান বাংলাদেশের ড্রাইভারসহ ১০টি পদের নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠলে পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে তা স্থগিত করা হয়। এতে তাৎক্ষণিকভাবে নিয়োগ প্রার্থীরা বিক্ষোভ করেন। তবে পরীক্ষার আগে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে প্রথমে দক্ষিণখান এলাকা থেকে অফিস সহায়ক হারুনুর রশিদকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এমটি অপারেটর মোহাম্মদ মাহফুজুল আলম ও এনামুল হককে গ্রেফতার করা হয়। একই দিন পৃথক অভিযানে দক্ষিণখানের মধুবাগ এলাকা থেকে এমটি অপারেটর জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর বিমানের বলাকা কার্যালয়ের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয় অফিস সহায়ক আওলাদ হোসেনকে। গতকাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মাদ হারুন অর রশীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ বিষয়ে আমরা এখনই কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। তদন্ত চলছে। তবে তদন্তের অগ্রগতি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। জানা গেছে, ১০ জনকে গ্রেফতার করা হলেও তাদের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, গত ২১ তারিখের নিয়োগ পরীক্ষাই নয়-এর আগেও বিমানের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। একই সিন্ডিকেটের সদস্যরা সে সময়ও প্রশ্নপত্র পত্র ফাঁস করে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়েছেন। সর্বশেষ প্রশ্ন ফাঁসে অন্যতম সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছেন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের গাড়িচালক মাহবুব আলী। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় একের পর এক বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই মাহবুব আলী ও এমএলএসএস জাকির হোসেন আত্মগোপনে চলে যান। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার তদন্তে সহায়তার জন্য বিমানের এমডিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডাকলেও তিনি তাতে সাড়া দেননি। তবে গত রাতে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় বিমানের এমডি মো. যাহিদ হোসেনের। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে তদন্তে সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে। ডিবি কার্যালয়ে যাওয়ার বিষয়ে কোনো কথা হয়নি বলে দাবি তার।

সূত্র বলছে, গ্রেফতারকৃতদের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করেন সংশ্লিষ্টরা। মামলার এজাহারেও সেগুলো সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন মামলার বাদী উপপরিদর্শক মো. শরিফুল ইসলাম। মামলার এজাহারের একটি অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, শুরুর দিকে গ্রেফতারকৃত বিমানের আটজন কর্মচারী মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. জাহিদ হাসান, আওলাদ হোসেন, মো. হারুন অর রশীদ, এনামুল হক, মাহফুজুল আলম এবং সমাজু ওরফে সোবহানের কাছ থেকে জব্দকৃত মোবাইলে এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদে, প্রাথমিক তদন্তে, বিভিন্ন তথ্যের এবং প্রযুক্তিগত তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, ২০ অক্টোবর থেকে ২১ অক্টোবর বেলা ২টার মধ্যে তারা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। এনালগ ও ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে বিপুল অর্থের বিনিময়ে ওই প্রশ্নপত্র ক্রয়-বিক্রয় করা হয়।

আদালত সূত্র বলছে, নিম্নপদস্থ এসব কর্মচারীর সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কীভাবে যোগাযোগ হতো এবং কীভাবে অর্থ লেনদেন হতো সেগুলোও বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে তারা প্রশ্নপত্র সর্বনিম্ন ২ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। প্রশ্নপত্র বিক্রিতে তাদের ক্লায়েন্ট কারা ছিল সে সম্পর্কিত তথ্য ও রয়েছে। গ্রেফতারকৃত অনেকের জবানিতেই উঠে এসেছে একজন জিএমের নাম।

জানা গেছে, বিমানের নিয়োগ পরীক্ষার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান ছিলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. যাহিদ হোসেন। এ ছাড়া কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ, বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ট্রেনিং সেন্টারের (বিএটিসি) অধ্যক্ষ এ বি এম নাজমুল হুদা, মহাব্যবস্থাপক (জিএসই) তাইজ ইবনে আনোয়ার, মহাব্যবস্থাপক আইটি (ভারপ্রাপ্ত) মো. আনোয়ারুল হক।

বিমানের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিমানের নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে অতীতেও অনেকবার প্রশ্ন উঠেছিল। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরির বিভিন্ন ধাপে নিরাপত্তা ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। বিমানের প্রশাসনের নিম্নপদের অনেক কর্মচারী হয়েও অনেকের ওপর প্রভাব বিস্তার করতেন। নিয়োগ কমিটির অন্যতম সদস্য মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ বলেন, আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো তা নিয়েই আমরা ব্যস্ত সময় পার করছি। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।

সর্বশেষ খবর