শিরোনাম
শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

তিন তদারকি সংস্থা ঠেকাতে পারছে না ভেজালের বিস্তার

শামীম আহমেদ

তিন তদারকি সংস্থা ঠেকাতে পারছে না ভেজালের বিস্তার

ভেজাল পণ্যে সয়লাব বাজার। খাদ্যপণ্য, কসমেটিকস, জ্বালানি তেল, ইলেকট্র্রিক্যাল ও ইলেকট্র্রনিক পণ্য থেকে শিশুর ব্যবহার্য ডায়াপার, কোনো কিছুতেই আস্থা রাখতে পারছেন না ভোক্তারা। নকল ও ভেজাল পণ্য কিনে পদে পদে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতা। মানহীন খাদ্য ও কসমেটিকস পণ্য বাড়িয়ে তুলছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি। নকল ইলেকট্র্রিক্যাল ও ইলেকট্র্রনিক পণ্য বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনা। কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। ভেজাল জ্বালানি তেলে আয়ু কমছে যানবাহনের। দূষণ ঘটছে পরিবেশের। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও বাংলাদেশ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর নামে তিনটি সরকারি সংস্থা মাঠে থাকলেও ঠেকাতে পারছে না ভেজালের বিস্তার।

দেশে সব পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বিএসটিআই ৪ হাজার ৯৫টি পণ্যের মান প্রণয়ন করলেও ২২৯টি পণ্য তাদের বাধ্যতামূলক তালিকায় রয়েছে। ৯৪ শতাংশের বেশি পণ্য তাদের নজরদারির বাইরে। মান নির্ধারণ করা ৬ শতাধিক কৃষি ও খাদ্যপণ্যের মধ্যে বাধ্যতামূলক নজরদারির তালিকায় আছে মাত্র ৮৮টি। বাধ্যতামূলক তালিকায় থাকা পণ্যগুলোরও সঠিক তদারকি হচ্ছে না। ফলে মানহীন ও ভেজাল পণ্যে ছেয়ে গেছে বাজার। ভেজাল খাদ্যে শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগ।

সরেজমিন বাজার ঘুরে দেখা গেছে- বিস্কুট, পাউরুটি, চানাচুরসহ বিভিন্ন বেকারি পণ্যে স্পষ্টভাবে বাংলায় উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, পুষ্টি ও উৎপাদন উপকরণের তথ্য ও উৎপাদকের ঠিকানা লেখা বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অনুপস্থিত। এ নিয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বেকারি পণ্য আমদানিকারক, বিক্রেতা ও উৎপাদনকারীদের সতর্ক করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিলেও তার প্রভাব পড়েনি বাজারে। জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ থাকা পাউরুটি, বনরুটি, কেক মেয়াদ শেষে আবারও ফেরত যাচ্ছে বেকারিতে। নতুন মেয়াদ লাগিয়ে ফিরে আসছে দোকানে। কসমেটিকস পণ্যের মেয়াদ শেষে কাগজের স্টিকার লাগিয়ে বাড়ানো হচ্ছে মেয়াদ। লাগেজ পার্টির মাধ্যমে আনা বিদেশি পণ্য বলে দেদার বিক্রি হচ্ছে নকল কসমেটিকস ও খাদ্যপণ্য। অনেক প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইর মান সনদ নিলেও পরবর্তীতে বাজারে মান বজায় রাখছেন কি না তা যাচাই হচ্ছে না। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে অভিযান হলেই সামনে আসছে ভেজালের চিত্র। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ২৮২টি খাদ্যপণ্যের নমুনা পরীক্ষা করে ১৫২টি পণ্যে অনিরাপদ উপাদান পেয়েছে। আগের বছর ২ হাজার ৩৫৮টি নমুনা পরীক্ষায় ভেজাল মিলেছিল ২৬৮টিতে। ভোক্তারা বলছেন, চোখের সামনেই ভেজাল পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এ নিয়ে অভিযানের খবর মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে দেখা গেলেও বাস্তবে খুব একটা চোখে পড়ে না। রাজধানীতে এমন এলাকাও পাওয়া গেছে যেখানে গত পাঁচ বছরের মধ্যেও ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান দেখেনি স্থানীয়রা। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান নেই বললেই চলে।

এ নিয়ে বাজার মনিটরিংয়ে সরকারের তিন তদারকি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, ভেজাল রোধে তারা সক্ষমতা অনুযায়ী নিয়মিত বাজার তদারকি করছেন। তবে জনবল কম হওয়ায় তাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

বিএসটিআই বলছে, তারা ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৬০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ও ২ হাজার ২৪টি সার্ভিল্যান্স টিম পরিচালনা করে ৩ হাজার ১৫৩টি মামলা ও ১৩ কোটি ৪৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে। কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে ২১ জনকে। চলতি বছরের জুলাই-অক্টোবরে ৬৫২টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ও ৬৫৩টি সার্ভিল্যান্স টিম পরিচালনা করে ১ হাজার ৩৩টি মামলা ও ৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে তিনজনকে। সিলগালা করা হয়েছে ২১টি কারখানা। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (মান) নিলুফা হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। তবে এত বড় বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য আরও জনবল লাগবে। ডিসেম্বরের মধ্যে ৯২ জন নতুন কর্মকর্তা যোগদান করবেন। তখন কাজ বাড়বে। এ ছাড়া ১৩৫টি পদ অনুমোদন হয়ে আছে এবং ১৯২টি পদ সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সিএম (সার্টিফিকেশন মার্কস) শাখার উপ-পরিচালক মো. রিয়াজুল হক। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বলছে, তারা সরকারি ছুটির দিনেও বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ১০ হাজার ৬২৫টি অভিযান চালিয়ে পণ্যে ভেজাল দেওয়ার অভিযোগে ২৫ হাজার ৬১৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে ১৭ কোটি ৫৯ লাখ ১২ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। এ ছাড়া ভোক্তার অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে ৬২১টি প্রতিষ্ঠান থেকে ৪৪ লাখ ৫১ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। খাদ্যে ভেজাল রোধ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, আমরা গ্যাস সিলিন্ডার, ই-কমার্স, রেলের টিকিট, খাদ্যপণ্য সবকিছুই দেখছি। যেখানেই অভিযোগ পাচ্ছি, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। সব তো একার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। খাদ্যে ভেজাল রোধে সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের অন্য কিছু দেখতে হয় না। তিনি বলেন, ভোক্তারা সচেতন না হলে ও ব্যবসায়ীদের মানসিকতায় পরিবর্তন না এলে শুধু অভিযানে কাজ হবে না।

এদিকে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ২০২১-২২ অর্থবছরে সারা দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে ১৬৪টি। এতে ১৪১টি মামলা দায়ের ও ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। কম মোবাইল কোর্ট পরিচালনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সদস্য (জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি) মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ বলেন, যারা ভেজাল দেয় তারা মনেই করে না এটা অপরাধ বা তাকে ধরার কেউ আছে। আমরা খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন করেছি। দরকার প্রয়োগ। অভিযান চালাতে প্রতি জেলায় আমাদের লোক আছে মাত্র একজন। তাকে অভিযানে যেতে পুলিশ প্রয়োজন হয়। চাইলেই পুলিশ পাওয়া যায় না। অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করছি। তবে মোবাইল কোর্ট ছাড়াও বছরে ১২-১৩ হাজার বাজার মনিটরিং করছি। তিনি বলেন, এখানে খাবারের দোকান দিতে লাইসেন্স লাগে না। সিএনজি চালকও রমজান মাসে ইফতার নিয়ে বসে পড়ে। ১৮ কোটি মানুষের দেশ। মানুষ সচেতন না হলে এভাবে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে ঘুরে ভেজাল খাদ্য রোধ সম্ভব নয়। ভেজাল খাদ্য বয়কট করতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে।

 

সর্বশেষ খবর