বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রবাসী আয় আনার চেষ্টা

শাহেদ আলী ইরশাদ

প্রবাসী আয় আনার চেষ্টা

এপ্রিলে শুরু হওয়া ডলার সংকট বছর শেষেও কাটেনি। বরং দিনে দিনে তা প্রকট হয়েছে। ইউক্রেনে হামলার পর থেকে বাংলাদেশে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে। ৮৪-৮৫ টাকার ডলার দাম বেড়ে ১০২ থেকে ১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ব্যাংকে। খোলাবাজারে ৮৮ থেকে ৮৯ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ১১২ থেকে ১১৫ টাকায় উঠেছে।

ডলারের দাম বাড়ার পাশাপাশি বৈধ পথে রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। ডলার সংগ্রহের উৎসগুলো সংকুচিত হয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে আমদানি ব্যয় মেটাতে কৌশলী হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কমিয়ে দিয়েছে ঋণপত্র (এলসি) খোলা, যার প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে।

ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর বিশ্বজুড়ে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। ফলে আমদানি খরচ আর কমেনি। অন্যদিকে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ও বাড়েনি। ফলে দেশে ডলার সংকট প্রকট হয়ে ওঠে।

রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট ডলার সংকট সমাধানে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার রোধে জুলাই থেকে আমদানি-রপ্তানিতে ওভার ইনভয়েসিং-আন্ডার ইনভয়েসিং যাচাই শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ডলার সংকটের এই সময়ে অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি রোধে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে খাদ্যপণ্য, সার ও জ্বালানি আমদানির এলসি খোলা নিশ্চিত করতে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ডলারের দাম নিয়ে চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এপ্রিল থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। পরে সেই দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় ব্যাংকগুলোর হাতে। ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদার নেতারা মিলে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে ডলারে দাম নির্ধারণ করছেন।

বছরের মাঝামাঝিতে ভয়াবহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট জনজীবন, কর্মসংস্থান ও সার্বিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় তৈরি করে। সরকার বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে খরুচে প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দেয়। ৯ অক্টোবর ৩৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ ছিল, ৩৬টি কেন্দ্র সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করা হয় এবং ৬২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আংশিক উৎপাদনে ছিল। রাতের পিক-আওয়ারে লোডশেডিং থাকছে প্রায় পৌনে ২ হাজার মেগাওয়াট। রিজার্ভ বাঁচাতে আমদানি-নির্ভর প্রাথমিক জ্বালানি কম কিনে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রেখে পরিকল্পিত লোডশেডিং করা এবং নাগরিকদের বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

আমদানি ব্যয় কমাতে ৩৩০টি পণ্যের তালিকা তৈরি করেছে সরকার। আমদানি নিরুৎসাহিত করতে এর আগে মে মাসে ১৩৫টি পণ্যে শুল্ক বাড়ায় সরকার। ৭ নভেম্বর গণভবনে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা সভায় আমদানি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ তালিকার কথাই বলেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। এতে আমদানি কম হবে ১০০ কোটি ডলারের।

মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু করা নতুন অর্থবছরে সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হাঁটছে। অর্থবছরের শুরুতেই প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিতে প্রকল্পের ক্যাটাগরি নির্ধারণ, যানবাহন কেনা বন্ধ, সরঞ্জাম কেনায় বরাদ্দের অর্ধেক অর্থ ব্যবহার, উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কমিটির সম্মানী ব্যয় বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

হুন্ডি ঠেকাতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে সরাসরি রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়াতে ২৯ নভেম্বর এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে রেমিট্যান্স সংগ্রহের অনুমতি দিয়ে সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিদেশে কর্মরত প্রবাসীরা যথাযথ ই-কেওয়াইসি পরিপালন করে মোবাইল ব্যাংকিং অর্থাৎ এমএফএসে হিসাব খুলে দেশে আত্মীয়স্বজনের কাছে যে কোনো সময় ও ইচ্ছেমতো অর্থ পাঠাতে পারবেন।

ডলারের কেনাবেচায় অতিরিক্ত মুনাফা করে বাজার অস্থিতিশীল করার অভিযোগে দেশি-বিদেশি ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) কাছ থেকে ব্যাখ্যা তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক এমডিদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ব্যাখ্যা তলব করে। একই অভিযোগে এর আগে ৮ আগস্ট অপসারণ করা হয় ওই ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী সময়ে ট্রেজারি প্রধানদের স্বপদে বহাল রাখার অনুমতি দিয়েছে।

ডলার নিয়ে কারসাজি করায় আট মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ৪২টিকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছিল। ৯টি মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স না নিয়ে এত দিন ব্যবসা করে আসছিল।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রেখে চলমান ডলার সংকটের সমাধান ও সব ধরনের আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ পাওয়া যাবে। যদিও আইএমএফ এই ঋণ দিতে অনেকগুলো শর্ত দিয়েছে বাংলাদেশকে। সরকার ইতোমধ্যে এসব শর্ত পরিপালন শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের আশপাশে ওঠানামা করছে। এ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলসহ কয়েকটি তহবিলে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৮০০ কোটি ডলার। এটি বাদ দিলে রিজার্ভ থাকে ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর