রবিবার, ১ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

গণপিটুনিতে ৩৬ জন নিহত

আসকের বার্ষিক প্রতিবেদন

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদায়ী ২০০২ সালে গণপিটুনিতে ৩৬ জন নিহত হয়েছেন। এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের, কথিত ক্রসফায়ারে মারা গেছেন চারজন। মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৯৩৬ নারী। এ ছাড়া বছরজুড়ে ২২৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। গতকাল আসক কার্যালয়ে ২০২২ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন হয়। সেখানে বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আসকের পরিচালক (কর্মসূচি) নিনা গোস্বামী এবং জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির। সভাপতিত্ব করেন এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন আসকের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান।

আসক জানায়, ২০২২ সালে বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ২২৬ জন সাংবাদিক। এর মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৭৯ জন সংবাদকর্মী। দুর্বৃত্তদের গুলিতে কুমিল্লায় নিহত হন একজন সাংবাদিক। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক লাঞ্ছিত ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় বাধা প্রদানের শিকার হয়েছেন ১৪ জন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এ বছর এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। আসক তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে শুধু র‌্যাবের সঙ্গে কথিত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন চারজন। কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, কক্সবাজার ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় এ ঘটনাগুলো ঘটে। এ ছাড়া বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা যান ১৫ জন। এর মধ্যে গ্রেফতারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শারীরিক নির্যাতনে চারজন, হার্ট অ্যাটাকে একজন এবং গ্রেফতারের আগে শারীরিক নির্যাতনে চারজন মারা যান। এ ছাড়া থানা হেফাজত আত্মহত্যা করেন দুজন এবং অসুস্থ হয়ে মারা যান চারজন। থানা হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগের পর নানা সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সিসিটিভি ওই সময়ে কার্যকর ছিল না বলে দাবি করে, যা তাদের দায়িত্বশীল আচরণের পরিপন্থী বলেও উল্লেখ করে আসক। আসক জানায়, এ বছর দেশের কারাগারগুলোর মধ্যে ২১টিতে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ৬৫ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৮ ও হাজতি ৩৭ জন। এর মধ্যে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে সর্বাধিক ১৬, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৪ ও চট্টগ্রাম কারাগারে ১২ জন মারা যান।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুম : গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সংগৃহীত আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন পাঁচজন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে চারজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে, পরবর্তীতে ফিরে এসেছেন একজন। আসক জানায়, যখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটকের ঘটনা ঘটছে, তখন পরিবার ও স্বজনদের দাবির মুখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার বা আটকের কোনো তথ্য না দিয়ে সরাসরি নাকচ করে দিচ্ছে। কিন্তু এরপর বিভিন্ন অভিযোগে উল্লিখিত আটক ব্যক্তিদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরে গ্রেফতার দেখাচ্ছে।

সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন : ২০২২ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ১৬ জনসহ মোট ২৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বাধিক লালমনিরহাট জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় সাতজন, কুড়িগ্রাম জেলায় তিনজন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় তিনজনসহ দেশের অন্যান্য সীমান্তবর্তী জেলায় আরও ১০ জন নাগরিক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ কর্তৃক ১৫ জন নাগরিক মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

নারী নির্যাতন : আসক জানায়, ২০২২ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৯৩৬ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। ধর্ষণের ঘটনা সর্বাধিক ৮৮টি ঘটেছে ঢাকা জেলায়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে ৮৩, চট্টগ্রামে ৫২, গাজীপুরে ৪৯টিসহ বাকি সব জেলায়ই ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন মোট ১ হাজার ৩২১ নারী। এ ছাড়া এ বছর যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২৪৭ জন নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন ৭৮ জন পুরুষ। এ বছর উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন সাত নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে আটজন পুরুষ খুন হয়েছেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৭৯ নারী। যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ২৯২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯৭ জন। ২০২১ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৬৪০ জন নারী। অন্যদিকে ২০২২ সালে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ১৭৪ নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৭৯ জন নারী এবং আত্মহত্যা করেন সাত নারী। আসকের তথ্যমতে, ২০২২ সালে সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে ছয়জন নারী নির্যাতনের শিকার হন। এর মধ্যে সালিশে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন পাঁচজন, নির্যাতন-পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যা করেন এক নারী।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালে সালিশ ও ফতোয়ার শিকার হয়েছিলেন মোট ১২ জন নারী। এ ছাড়া এ বছর ২৬ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পরবর্তী সময়ে মারা যান ১২ জন নারী। অন্যদিকে এ বছরে অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ১৩ জন নারী।

শিশু অধিকার : বিদায়ী বছরে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণ-চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় মোট ৫১৬ শিশু। নিহতের মধ্যে ঢাকা জেলায় সর্বাধিক ৬৪, গাজীপুরে ৩৬ ও নারায়ণগঞ্জে ৩৩ শিশু রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে নিহত শিশুর সংখ্যা ছিল ৫৯৬। এ ছাড়া ২০২২ সালে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ১ হাজার ৮৮ শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় ৫৬০ শিশু, ধর্ষণ-চেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয় ১০০ শিশু এবং বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৫২ ছেলেশিশু। বিভিন্ন মাদরাসায় ছেলেশিশু বলাৎকারের অভিযোগ ছিল উদ্বেগজনক।

উল্লেখ্য, বলাৎকারের শিকার ৫২ ছেলেশিশুর মধ্যে কমপক্ষে ৩৪ জন বিভিন্ন মাদরাসায় বলাৎকারের শিকার হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর