শুক্রবার, ৫ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

আইস এখন আতঙ্ক

ভয়ংকর এই মাদক ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

আইস এখন আতঙ্ক

ভয়ংকর মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইস দেশে আগ্রাসন শুরু করেছে। দেশি-বিদেশি অর্ধশতাধিক চক্র রয়েছে এর নেপথ্যে। দক্ষিণ এশিয়ার মাদকের রাজধানী খ্যাত মিয়ানমারের সান স্টেট থেকে সাত আন্তর্জাতিক রুট হয়ে কমপক্ষে ২০টি পয়েন্ট দিয়ে তা দেশে প্রবেশ করছে। ১১টি অভ্যন্তরীণ রুট হয়ে ক্রিস্টাল মেথের চালান ছড়িয়ে পড়ছে দেশে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ক্রিস্টাল মেথ পাচারের আদ্যোপান্ত। মাদকনিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘ক্রিস্টাল মেথের আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ রুট চিহ্নিত করতে কাজ চলছে। এরই মধ্যে কিছু রুট চিহ্নিত করা হয়েছে। রুট চিহ্নিত করার পর এ বিষয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করা হবে।’ মাদকনিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এর আগে ক্রিস্টাল মেথসহ গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে এবং বিভিন্ন সোর্সের পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাদক পাচারের রুটগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে মাদক পাচারের হোতাদের বিষয়েও তথ্য পাওয়া গেছে। সোর্সের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যেও ক্রিস্টাল মেথ পাচারে তাদের সম্পৃক্ততা উঠে এসেছে। এসব পাচারকারীর প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে।’

মাদকনিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের জোগান আসে মিয়ানমারের সান স্টেট থেকে। এ সান স্টেটকে বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার মাদকের রাজধানী। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, লাওস, থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এ মাদক পাচার হয় সেখান থেকে। সান স্টেট থেকে কমপক্ষে সাতটি আন্তর্জাতিক রুট হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ক্রিস্টাল মেথ। ক্রিস্টাল মেথ পাচারের আন্তর্জাতিক সাত রুটের মধ্যে রয়েছে সান স্টেট-তুয়াঙ্গী-ইয়াঙ্গুন হয়ে বাংলাদেশ। মান্দালে-তুয়াঙ্গী-মাগওয়ে-মিনবু-পাদান-সিত্তেই-মংডু হয়ে বাংলাদেশ। মান্দালে-সাগাইং অঞ্চল-মনেয়া-কালে-মোরে (মণিপুর)-আইজল (মিজোরাম)-পানিসাগর-শিলং-করিমগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশ। শিলং-শিলিগুড়ি-মালদা হয়ে বাংলাদেশ। বাকি তিনটি রুট সাগর পথে। মিয়ানমার থেকে সবচেয়ে বেশি আইস আসে কক্সবাজার, বান্দরবান হয়ে। যার মধ্যে রয়েছে বান্দরবন ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকার তমব্রুর ফুলতলী, লম্বাশিয়া, ভালুরখাইয়া, চাকঢালাদৌছড়ি ও ওয়ালিডং সীমান্তের কোনারপাড়া, উত্তরপাড়া এবং বাইশফাঁড়ি। এরপর ক্রিস্টাল মেথ দুটি রুট হয়ে দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ রুটগুলো হল নাইক্ষ্যংছড়ি-রামু-কক্সবাজার হয়ে চট্টগ্রাম এবং নাইক্ষ্যংছড়ি-আলিকদম-লামা-চকোরিয়া-লোহাগাড়া-সাতকানিয়া-বান্দরবান হয়ে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন পন্থায় যায় দেশের অন্য অঞ্চলে। কক্সবাজারের টেকনাফ ও মংডু-আকিয়াব সীমান্ত এলাকার উখিয়ার ভালুখিরার সিকদারপাড়া, বাইশফাঁড়ির নারাইনশন, কাস্টমের ভেউবুনিয়া, থাইনখালীর চাকমাকাটা, পালংখালীর লাম্নহালী, টেকনাফ উপজেলার চাকমারকুল এলাকার কোয়ানচিবন, হোয়াই্যকং এলাকার ডেউবুনিয়া, উনচিপ্রাংয়ের খোয়ারহাশী, কাঞ্জনপাড়ার শীলখালী, জীম্মনখালীর জিয়ানহালী, নয়াবাজারের কুয়ারবিল, হ্নীলার নাখপুরা, মুছনীর রাম্মাঘোনা, জানীমুড়ার রংগাদন, নাইট্যংপাড়ার পেরানপুরু, টেকনাফ জেটি এলাকার খায়ামখালী, সাবরাংয়ের মংডু শহর, খোলারপাড়ার মন্ত্রীপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের নাইক্কনদীয়া এবং সেন্টমার্টিনের মেরুল্লা। কক্সবাজারের এসব স্পট দিয়ে প্রবেশ করা ক্রিস্টাল মেথ সাতটি রুটে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার হয়। এ রুটগুলোর মধ্যে রয়েছে টেকনাফ-উখিয়া-মরিচ্যা-লিংকরোড-কক্সবাজার-রামু, টেকনাফ-উখিয়া-রেজুখাল ব্রিজ-কক্সবাজার-রামু হয়ে চট্টগ্রাম, গর্জনীয়-নাইক্ষ্যংছড়ি-রামু চা বাগান-ঈদগাঁও হয়ে চট্টগ্রাম, সোনাইছড়ি-পাঞ্জেখানা বাজার-রামু হয়ে চট্টগ্রাম। নৌপথে চার রুট হচ্ছে সেন্টমার্টিন-সোনদিয়া-মহেশখালী-বদরখালী-চকোরিয়া-পেকুয়া হয়ে চট্টগ্রাম। ক্রিস্টাল মেথ পাচারের অপর রুটটি হচ্ছে মহেশখালী-কুতুবদিয়া-আনোয়ারা হয়ে বাঁশখালী। সেন্টমার্টিন-ভাসানচর হয়ে বরিশাল এবং সেন্টমার্টিন-ভাসানচর হয়ে ঢাকা।

নেপথ্যে যারা : মাদকনিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে, দেশে ক্রিস্টাল মেথ পাচারের নেপথ্যে রয়েছে মিয়ানমারভিত্তিক এবং দেশীয় অর্ধশতাধিক চক্র। মিয়ানমারের সান স্টেট থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত ক্রিস্টাল মেথের চালান পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে সাতটি গ্রুপ। যার মধ্যে রয়েছে সান স্টেট ভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ, ইইনাইটেড স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউসিএ), আরাকান আর্মি, মিয়ানমার সেনা নিয়ন্ত্রিত মিলিশিয়া। দেশের অভ্যন্তরে পাচারের নেপথ্যে রয়েছে কয়েকজন রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি।

মাদকনিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘ক্রিস্টাল মেথ পাচারের জন্য নতুন করে মাদক মাফিয়া সৃষ্টি হয়নি। ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারীদের কেউ কেউ এখন ক্রিস্টাল মেথ পাচারে সম্পৃক্ত। তাদের চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর