পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মীর্জা এবং কন্যাদের ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। হাই কোর্টে জমা দেওয়া সংস্থাটির অগ্রগতি প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পর চার দিনে বেনজীর পরিবারের ১০টি ব্যাংক হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। আর এখন পর্যন্ত দলিল প্রদর্শিত মূল্যের হিসাবে এই পরিবারের ৪৩ কোটি টাকার বেশি মূল্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স্থাবর সম্পত্তির তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরেও আরও জমি-ফ্ল্যাটের তথ্য পাওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে দুদক বলেছে, কোথাও মূল্য উল্লেখ না থাকায় প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসব সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। তবে নিরপেক্ষ প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান গতকাল প্রতিবেদনের তথ্য সাংবাদিকদের জানান। তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি হাই কোর্টে উপস্থাপনের জন্য হলফনামা করে জমা দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের কার্যতালিকায় এলে সোমবার (আজ) প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সম্পদের তথ্য চেয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শকের কার্যালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স (বিএফআইইউ), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর চেয়ারম্যান, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যান, বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ সরকারি-বেসরকারি ৪৬টি দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রায় সব দপ্তর থেকে রেকর্ডপত্র পাওয়া গেছে। এসব রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, স্থাবর সম্পদের মধ্যে ঢাকা জেলা, ঢাকা মহানগর, নারায়ণগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, গাজীপুর, কক্সবাজার, খুলনায় বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মীর্জা ও তাদের তিন মেয়ে- ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর, তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীর ও যাহারা যারীন বিনতে বেনজীরের মালিকানাধীন জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, রিসোর্ট ও বাংলো রয়েছে। তাদের ১১৬টি ব্যাংক হিসাবের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের মধ্যে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। এ ছাড়া জয়েন স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে নিবন্ধিত পূর্ণ এবং আংশিক মালাকানাধীন একাধিক কোম্পানির তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলোতে তাদের কোটি কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে। তাছাড়া ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ নিবন্ধিত একাধিক ব্রোকারেজ হাউসে তাদের নামে বেশ কয়েকটি (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) বিও অ্যাকাউন্ট ও সেসব অ্যাকাউন্টে লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
ঢাকায় কমিউনিটি ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা থেকে বেনজীর আহমেদ, স্ত্রী জীশান মীর্জা ও মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীরের অস্বাভাবিক লেনদেনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পর (২৩, ২৪ ও ২৯ এপ্রিল) দ্রুত সময়ে সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ (৬ কোটি ৫২ লাখ ৭৮ হাজার ৯৬৮ টাকা) টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৯ এপ্রিল ঢাকায় সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা থেকে আউটার ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ৩ কোটি, ৩০ এপ্রিল ৩ কোটি ৭ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। একই দিনে (৩০ এপ্রিল) সাভানা ফার্ম প্রোডাক্টটস নামের একটি চলতি হিসাব থেকে ১৪ লাখ টাকা উত্তোলন করেন বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানেরা।
প্রতিবেদনে স্থাবর সম্পদ জব্দ, অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ ও দেখভালের জন্য রিসিভার নিয়োগে ফিরিস্তি, আদালতের আদেশ ও তারিখ তুলে ধরে অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বক্তব্য জানতে বেনজীর আহমেদকে গত ৬ জুন ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আসেননি। যে কারণে ২৩ জুন তাকে ফের ডাকা হয়। সেদিনও তিনি আসেননি। এ ছাড়া স্ত্রী জীশান মীর্জা ও দুই মেয়ে- ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর, তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীরের বক্তব্য জানতে ৯ জুন ডাকা হয়েছিল। ওইদিন না আসায় ২৪ জুন তাদের আবার ডাকা হয়। সেদিনও তারা আসেননি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানকালে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত রেকর্ড ও তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, বেনজীর আহমেদের নামে মোট ৯ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৫৬৫ টাকা, তার স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে ২১ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৪৩ টাকা, বড় মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীরের নামে ৮ কোটি ১০ লাখ ৮৯ হাজার ৬৯৬ টাকা, মেজো মেয়ে তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে ৪ কোটি ৭৫ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৮ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। শুধু স্থাবর সম্পদের দলিলে প্রদর্শিত মূল্য বিবেচনায় নিয়ে এই তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া বেনজীর আহমেদের নামে বান্দরবান সদর উপজেলায় ২৫ একর লিজ (ইজারা) জমি, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের দোশরপাড়া ও বালুচর মৌজার ধলেশ্বরী সমবায় সমিতি লিমিটেড-এ বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে একটি করে মোট ২টি প্লট (জমির পরিমাণ ১৪ কাঠা) রয়েছে। ঢাকায় উত্তরা আবাসিক এলাকায় জীশান মীর্জার নামে ৩ কাঠা জমি ও এই জমির ওপর সাত তলা বাড়ি, আদাবরে পিসি কালচার হাউজিংয়ে ৬টি ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা উচ্চ আদালতকে জানিয়েছে দুদক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব সম্পদের মূল্য কোথাও উল্লেখ নেই এবং প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসব সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। এসব সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করা গেলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মূল্য আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব সম্পদের তথ্য ছাড়াও অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে-বেনামে, দেশে-বিদেশে আরও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। গত ৩০ জুন অনুসন্ধান প্রতিবেদন দুদকে দাখিল করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে দুদকের অগ্রগতি প্রতিবেদনে।
এর আগে, ২৩ এপ্রিল বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধনে দুদক যে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে, সেই কমিটির কার্যক্রমের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন হাই কোর্ট। দুই মাসের মধ্যে কমিটিকে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। এ সংক্রান্ত রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে ৩০ জুলাই বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। সেদিন বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন রিটকারীর আইনজীবী এম সারওয়ার হোসেন।