দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে পানি। এমন অবস্থায় দুর্গত এলাকায় রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে সবখানেই চিকিৎসাসেবা ও ওষুধপত্রের সংকট দেখা দিয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরে বানের পানি কমতে শুরু করায় পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি ও চর্মরোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত জেলার ৫টি উপজেলায় শিশুসহ ২ হাজারের অধিক বানভাসি মানুষ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। এর পরের অবস্থানে রয়েছে জ্বর, সর্দি। দুই দিন ধরে স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রসহ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও বেড়েছে রোগীর চাপ। শয্যা সংকটের কারণে অনেক রোগী হাসপাতালের মেঝেতে থেকে নিচ্ছেন চিকিৎসাসেবা। আক্রান্তদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তার, নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে কলেরা স্যালাইন, সিরাপ সালফুটামল, হিসটাসিন ও ডায়রিয়া অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য ওষধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
বিকালে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, ডায়রিয়া ওয়ার্ডে তিলধারণের জায়গা নেই। এক একটি বেডে একাধিক রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অনেক রোগীকেই সিটে জায়গা না দিতে পারায় হাসপাতালের ফ্লোরে বিছানা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নার্স সংকটে রোগী ও তাদের স্বজনদের ভিড় ঠেলে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। একই অবস্থা জেলার রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালগুলোরও। লক্ষ্মীপুরের সিভিল সার্জন ডা. আহমদ কবির জানান, হাসপাতালগুলোতে রোগী বাড়ায় স্যালাইনসহ ওষুধের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
নোয়াখালী : নোয়াখালীতে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। ফলে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন লোকজন। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, নোয়াখালীতে ১৬ লাখ ৪ হাজার ৩০০ মানুষ এখনো পানিবন্দি। ৯০১টি আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৭৮৮ জন। জেলায় ২২০টি ঘর পুরনো এবং ৫ হাজার ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি ১২৪টি এবং বেসরকারি ১৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১১। সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে নগদ ৪৫ লাখ টাকা, ১ হাজার ৭১৮ মেট্রিক টন চাল, ১ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, ৫ লাখ টাকার শিশুখাদ্য ও ৫ লাখ টাকার গো-খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে চলমান বন্যা নিয়ে মঙ্গলবার অক্সফাম বাংলাদেশ প্রকাশিত জরুরি চাহিদা নিরূপণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে নোয়াখালী ও ফেনী জেলায়। দুই জেলার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বন্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ধ্বংস হয়েছে ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর। এ ছাড়া দুই জেলার পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ও সুপেয় পানির সুবিধা শতভাগ অচল রয়েছে।
ফেনী : ফেনীর রাজাপুর, সিন্দুরপুর, পূর্ব চন্দ্রপুর, জায়লস্কর, পাঁচগাছিয়া, শর্শদি ও মোটবি ইউনিয়নের কিছু গ্রাম ছাড়া জেলার অন্যান্য স্থান থেকে বানের পানি প্রায় নেমে গেছে। এসব গ্রামের গ্রামীণ সড়কগুলো এখনো পানি রয়েছে। এখনো ফেনী-রাজাপুর সড়কে পানি রয়েছে।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার ছয় উপজেলায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯১৪ কোটি টাকা। প্রাণিসম্পদ খাতে প্রায় ৩৯১ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বানের পানিতে তলিয়ে ৬৪ হাজার ১৬১টি গবাদিপশু ও ২৩ লাখ ৪ হাজার ৪১০টি হাঁস-মুরগির মৃত্যু হয়েছে। পোলট্রি ও মৎস্য খাত সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। কৃষি জমিগুলো তলিয়ে গেছে। পুঁজি হারিয়ে অনেকের পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কয়েকদিনে জেলার ছয়টি উপজেলায় বন্যায় মাছ চাষিদের ৭৫ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ সংশ্লিষ্ট অন্তত ২০ হাজার মানুষ। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে একক ও যৌথ মালিকানাধীন ১৮ হাজার ৭৬০টি পুকুর-দিঘি। এসব পুকুর থেকে ২২ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বড় মাছ এবং ১৯৭ লাখ টাকার মাছের পোনা ভেসে গেছে। এ ছাড়া জেলায় খামারিদের ৫৪ লাখ টাকার অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে গতকাল সন্ধ্যায় এক প্রেস রিলিজের মাধ্যমে জানানো হয়েছে, বর্তমানে জেলার কিছু স্থানে জলাবদ্ধতা ছাড়া বন্যার পানি নেমে গেছে। বন্যায় আনুমানিক ১০ লাখ মানুষ দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। জেলার বিভিন্ন উপজেলার ২২টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৪ হাজার ১৯ জন আশ্রিত রয়েছেন। জেলায় সরকারিভাবে দুটি মেডিকেল ক্যাম্প ও ১৪টি মোবাইল টিম চালু রয়েছে। বন্যায় জেলায় মোট ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে ফুলগাজী উপজেলার বন্যার্তদের মাঝে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিতরণ করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। গতকাল সকালে জিএম হাট উচ্চবিদ্যালয় ও বহুমুখী আশ্রয় কেন্দ্রের এ কে এম সিরাজুল ইসলাম মিলনায়তনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির উদ্যোগে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন ফেনী-১ আসনের বিএনপির সাংগঠনিক সমন্বয়ক ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে পরশুরামে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। শেখ কামাল অডিটরিয়ামে পরশুরাম উপজেলা ও পৌর যুবদলের উদ্যোগে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু।