আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তনের পর অনেক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আত্মগোপনে রয়েছেন। এসব চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে অনুপস্থিতির কারণে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নাগরিকরা। এ অবস্থায় দেশজুড়ে সব ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। তবে দায়িত্ব পালনরত চেয়ারম্যান-সদস্যরা পূর্ণ মেয়াদই থাকতে চাচ্ছেন।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর অনেক জনপ্রতিনিধি দেশ থেকে পালিয়েছেন, অনেকে আত্মগোপনে চলে যান। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের ও পৌরসভার মেয়র এবং উপজেলা চেয়ারম্যান রয়েছেন। এ জন্য সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করে। কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর ইউপি চেয়ারম্যানদের অপসারণ করেনি সরকার। নিয়ম অনুযায়ী এ চেয়ারম্যানরা কার্যালয়ে থাকার কথা থাকলেও তারা অনেকে আত্মগোপনে আছেন। এতে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন নাগরিকরা।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে এখন ইউনিয়ন পরিষদ আছে ৪ হাজার ৫৮০টি। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৬৪ জন চেয়ারম্যান নিয়মিত অফিস করছেন। বাকি ১ হাজার ৪১৬ জন চেয়ারম্যান অনুপস্থিত। এমন বাস্তবতায় শুধু দেড় হাজার নয়, সাড়ে ৪ হাজার ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারকেই অপসারণের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এ নিয়ে দোটানায় রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারও। তৃণমূলের এসব জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করার পর সেখানে বিপুলসংখ্যক প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। এত কর্মকর্তা কোথায় পাওয়া যাবে কিংবা সেই প্রশাসকেরা আদৌ কাজ করতে পারবেন কি না, এ নিয়ে আলোচনা চলছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। তবে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সেবাবঞ্চিত নাগরিকরা : কুমিল্লার লালমাই উপজেলার বাকই উত্তর ইউনিয়ন পরিষদ। আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তনের পর কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। চাঁদাবাজি, জোর করে জমি দখল, হামলা, প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, হয়রানির অভিযোগ দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর চিঠি দিয়ে অনাস্থা দিয়েছেন ইউপি সদস্যরা। ইতোমধ্যে চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়েছে। বর্তমানে তার স্থানে উপজেলা সহকারী কমিশনারদের (ভূমি) এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এটি তার অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকায় ইউপি কার্যালয়ে কম আসছেন। তিনি কম আসার কারণে সেবা পেতে ধীরগতি বা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নাগরিকদের। এ বিষয়ে কথা হয়, ইউপি সচিব তন্ময় চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, চেয়ারম্যান অপসারণ হওয়ার পর সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারজানা আক্তারকে দায়িত্ব দিয়েছে জেলা প্রশাসন। নিজের মূল কাজে ব্যস্ত থাকায় কার্যালয়ে সব সময় আসতে পারেন না তিনি। যে দিন আসেন না ওই দিন নাগরিক সেবার ডকুমেন্ট নিয়ে ম্যাডামের কার্যালয়ে গিয়ে স্বাক্ষর করে নিয়ে আসি। সেবাপ্রত্যাশীদের তেমন সমস্যা হয় না। স্থানীয় সরকার বিভাগের তথ্যমতে, ইউপি চেয়ারম্যানরা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা বিতরণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকেন। ওয়ারিশ সনদ, চারিত্রিক সনদ, জন্মনিবন্ধন, মৃত্যুনিবন্ধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হয়ে থাকে। গ্রামে বিভিন্ন সালিশ, নতুন রাস্তা নির্মাণ, পুরনো রাস্তা সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দিলে কিংবা চেয়ারম্যানদের অপসারণ করলে প্রান্তিক পর্যায়ে সরকারি সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। চেয়ারম্যানরা বলছেন, তাঁদের অপসারণ করলে গ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। চুরি, ডাকাতি বেড়ে যাবে। নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের (মেম্বার) অপসারণ না করার দাবি জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।
সার্বিক বিষয়ে কথা হয় ইউনিয়ন পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন নেতা, নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার ১ নম্বর বড়ভিটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ফজলার রহমানের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যানরা আত্মগোপনে রয়েছেন। এর সংখ্যা তিন ভাগের এক ভাগ। যেখানে অধিকাংশ চেয়ারম্যান নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, সেখানে চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা ঠিক হবে না। আমরা বাকি মেয়াদটুকু নাগরিকদের সেবা দিতে চাই। সার্বিক বিষয়ে নিয়ে আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাদের বিষয়টা দেখবেন বলেছেন। তারপরও আগামীকাল (আজ সোমবার) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আমরা মানবন্ধন করব। সেখানে অধিকাংশ ইউপি চেয়ারম্যান থাকবেন বলে আশা রাখি।