বাংলাদেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ-আমেরিকা। পশ্চিমের শীতপ্রধান এই দেশগুলোতে বড়দিন উপলক্ষে ব্যাপক বিক্রি হয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকানগুলোয়। নতুন নতুন পোশাক নিতে ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়েন। আর এই বিক্রিকে কেন্দ্র করে পোশাক ক্রেতাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসেন বাংলাদেশে। তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারাও বড়দিনের ডিসেম্বর-কেন্দ্রিক এই অর্ডার নিতে সারা বছর আশায় থাকেন। তবে এবার সেই আশার গুড়েবালি। বিকেএমইএর তথ্য মতে, প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্রয়াদেশ অন্য দেশে চলে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড়দিন উপলক্ষে ক্রেতারা জুন-জুলাই থেকে অর্ডার দিতে থাকেন। এই অর্ডারের বিপরীতে পরবর্তী ছয় মাস দেশের কারখানাগুলো সচল থাকে। সে কারণে জুলাই-ডিসেম্বরের বাণিজ্য সারা বছরের রপ্তানি খাতকে প্রভাবিত করে। এবার বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকে ডিসেম্বর অর্ডার নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বড়দিন উপলক্ষে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে রপ্তানি খাতে যে অর্ডার আসার কথা ছিল, অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে তা থেকে প্রায় আড়াই থেকে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্ডার কম এসেছে।
বিকেএমইএ সভাপতি বলেন, বড়দিনকে কেন্দ্র করে যে সময় দেশে অর্ডার আসে, তখন শুরু হলো কোটা আন্দোলন। কারফিউ জারির কারণে একপর্যায়ে মালিকরা কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। অভ্যুত্থানের পর আবার শ্রম আন্দোলনের কারণেও অনেক কারখানা বন্ধ ছিল। এ ছাড়া ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোতে এলসি জটিলতা ছিল বিগত সরকারের সময় থেকেই। এসব কারণে বড়দিনের সুবিধা নিতে পারেনি দেশের তৈরি পোশাক খাত। সক্ষমতা কমে যাওয়ায় প্রতিযোগী দেশগুলো বাংলাদেশের এই প্রাপ্য সুযোগ লুফে নিয়েছে। বিদেশি ক্রেতারাও সেদিকে চলে গেছেন। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান আন্তর্জাতিক বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। বিশেষ করে, বিদেশিদের আস্থা ফেরাতে ইতিবাচক প্রভাব রাখার সুযোগ করে দিয়েছে। তবে পরবর্তীতে শ্রমিক আন্দোলন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ার মতো বিষয়গুলো বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে নতুনভাবে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, আগস্টের শেষ সময় থেকে শুরু হওয়া শ্রম অসন্তোষের কারণে শুধু পোশাক খাতে ৪০০ মিলিয়ন বা ৪০ কোটি ডলার উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়র ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় এসেছে ১১ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। যা বিগত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ বেশি। ইপিবির হিসাবে দেখা যাচ্ছে, পোশাক খাতেও একই হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) প্রেসিডেন্ট আনোয়ার উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পোশাক খাতে নামমাত্র (৫ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি হয়েছে; ভারত, ভিয়েতনাম যে হারে প্রবৃদ্ধি করছে তার তুলনায় এটি খুবই কম। আমাদের আশঙ্কা ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি আরও কমে যাবে। সাবেক বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটেছে। এটিকে বড় ধরনের সুযোগ হিসেবে নিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেমন স্বাভাবিক হয়নি, তেমনি উৎপাদনমুখী কারখানাগুলোয় গ্যাসের সংকটও রয়ে গেছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে অদ্যাবধি নিশ্চয়তা মেলেনি। তিনি বলেন, বেশির ভাগ ক্রেতার স্থানীয় অফিস রয়েছে ঢাকায়। এখান থেকে যে তথ্য যাচ্ছে, সেখানে আস্থার অভাবটাই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।