নির্বাচনের আগে আবারও টালমাটাল হয়ে উঠেছে দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ড। চলছে নতুন হিসাবনিকাশ, দৌড়ঝাঁপ আর দখলযুদ্ধ। অপরাধ জগতে কদর বেড়েছে নয়া অপরাধীদের। প্রতিদিনই এ জগতে যুক্ত হচ্ছে নতুন মুখ ও আধুনিক অস্ত্রের ভান্ডার। সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে আসা একাধিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের নতুন সমীকরণের ভয়ংকর তথ্য। আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনের খুনের পর অস্থির হয়ে পড়েছে রাজধানী থেকে শুরু করে বন্দরনগর চট্টগ্রাম পর্যন্ত পুরো অপরাধজগৎ।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল ইফতেখার আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জনগণের জানমাল নিশ্চিত এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে র্যাব প্রয়োজনীয় সবকিছুই করবে। অপরাধীর অন্য কোনো পরিচয় র্যাবের কাছে ধর্তব্য নয়। চট্টগ্রাম এবং সিলেটে ইতোমধ্যে র্যাবের সফলতা সাধারণ মানুষ দেখেছে। বৈধ অস্ত্রের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে র্যাব গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সূত্র জানায়, ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে দীর্ঘদিন ধরে দাপট দেখানো শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল হক ইমনের হয়ে মাঠে কাজ করছে তার ঘনিষ্ঠ চাচা জাহিদ, আলমগীর, প্রিন্স ও ভাগলপুরের সুমন। গত ডিসেম্বর থেকেই মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়ায় অবস্থান করছেন ইমন। মালয়েশিয়ার একটি তামিল গ্যাংয়ের সহায়তায় তিনি শিগগিরই লাওসের পাসপোর্ট পাচ্ছেন। সেখান থেকেই কানাডায় পাড়ি জমানোর সব প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ছয় মাস আগেই মন্ট্রিলে তিনি অভিজাত বাড়ি কিনেছেন। মালয়েশিয়া, কানাডা ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ইমনের যোগাযোগ। রাজধানীর ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড ও হাজারীবাগে তার নির্দেশেই চলছে চাঁদাবাজি, দখলবাজি আর খুনোখুনি।
অনুসন্ধান বলছে, রাজধানীর মিরপুরে নতুন করে মাথা চাড়া দিয়েছে ভয়ংকর গ্রুপ ‘ফোর স্টার’। এ গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে মামুন, ইব্রাহিম, শাহাদাত ও মুক্তার। তাদের গডফাদাররা বিদেশে থাকলেও দেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে শতাধিক তরুণ সন্ত্রাসী। বেশির ভাগই কিশোর গ্যাং সদস্য। এ গ্রুপের ভয়াল দাপটে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে মিরপুরবাসী।
মিরপুরে ফোর স্টার গ্রুপের অন্যতম মুক্তারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাজন দুবাই থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তদারকি করছে। তবে দেশে তার এলাকার অপরাধকাণ্ড পরিচালনা করছে তপু, দাসা শরীফ, ফাইটার রাসেল, পিচ্ছি আশিক। ‘ঢ’ ব্লকের মামুনের হয়ে মাঠে পিচ্চি মাসুম, অপু। সম্প্রতি ৫ কোটি টাকা চাঁদা না পেয়ে পল্লবীর সাগুফতা এলাকায় একে বিল্ডার্সে হামলা চালায় মামুন বাহিনীর সদস্যরা। অপরদিকে ৩০ লাখ টাকা না পেয়ে ভাসানটেকে তাণ্ডব চালায় কিলার ইব্রাহিম গ্রুপ। আগারগাঁও ও কাজিপাড়ায়ও বিকাশ-প্রকাশ বাহিনীর নামে চলছে প্রকাশ্য চাঁদাবাজি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছর গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেল থেকে মুক্তি পান সানজিদুল ইসলাম ইমন, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, খোরশেদ আলম ওরফে ফ্রিডম রাসু, আরমানসহ অনেকে। ভারত থেকে ফেরেন মোল্লা মাসুদ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরেন আমিন রসুল সাগর।
তবে বিদেশে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং জেল ফেরত আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দেখা দিয়েছে মারাত্মক দ্বন্দ্ব। অনেকে পুরোনো নেতৃত্ব মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এ থেকেই শুরু হয় গ্রুপভিত্তিক বিভাজন ও সংঘর্ষ। ফলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে।
এরই মধ্যে গতকাল সোমবার দুপুরে আদালতপাড়ায় খুন হন শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈফ মামুন। পুলিশ সূত্র বলছে, মামুনকে হত্যার পেছনে রয়েছে ইমন গ্রুপের সদস্যরা। ইমন ও মামুন একসঙ্গে ছিল। তবে গত কয়েক বছর ধরে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। দুই বছর আগেও তেজগাঁও এলাকায় ইমনের থাবা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান মামুন। নিহত হন পথচারী ভুবন চন্দ্র শীল। এবার আদালতপাড়ায় দ্বিতীয় হামলায় প্রাণ হারালেন মামুন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা আরও জোরদার করা হয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কার্যকলাপ নজরদারিতে আছে। প্রয়োজন হলে দ্রুতই অভিযান পরিচালনা করবে ডিএমপির গোয়েন্দা ইউনিট। এদিকে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত শুধু মিরপুর জোনেই হত্যার শিকার হয়েছেন অন্তত ৪০ জন। এর মধ্যে পল্লবীতেই খুন ১৫ জন। দারুস সালাম, কাফরুল, ভাসানটেক, শাহ আলী, রূপনগর, মিরপুর মডেল- প্রতিটি থানাতেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে।
চট্টগ্রামেও দাপট আন্ডারওয়ার্ল্ডের : শুধু রাজধানী নয়, চট্টগ্রামও কাঁপছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দৌরাত্ম্যে। সেখানে শীর্ষ ছয় সন্ত্রাসী ও তাদের অনুসারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে রয়েছে বড় সাজ্জাদ, ছোট সাজ্জাদ, রায়হান আলম, মোবারক হোসেন ইমন, শহিদুল ইসলাম বুইস্যা ও ইসমাইল হোসেন টেম্পু।
গত ১৩ মাসে চট্টগ্রামে রাজনৈতিক বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুন হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন চালিতাতলীতে। সেই ঘটনায় নিহত হয় স্থানীয় সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা। এরপরের দিনই একই এলাকায় আবারও গোলাগুলি, পরদিন রাউজানে সংঘর্ষ- একের পর এক খুনে কেঁপে উঠেছে বন্দরনগরী।
আন্ডারওয়ার্ল্ডের গোপন সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে লুট হওয়া বহু অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এসব অস্ত্রের দখল নিয়েই চলছে নতুন দৌরাত্ম্য। এর বাইরেও সীমান্ত পার হয়ে সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছাচ্ছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। এর বাইরে সম্প্রতি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে অগ্নিকাে র সময় অন্তত ৩ হাজার পিস আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদ লুট হয়েছে। নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে তাদের নানা টার্গেট দেওয়া হচ্ছে। বেড়ে যেতে পারে টার্গেট কিলিং।