রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষক-কর্মচারীরাও গত বছর ১৬ জুলাই আন্দোলনরত ছাত্রদের দিকে ঢিল ছুড়েছিলেন বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছেন পুলিশের এএসআই মো. আবদুল্লাহ আল নাছির। গণ অভ্যুত্থানের সময় রংপুরে আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনাল-২ এ দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি এসব কথা বলেন। এ মামলায় প্রসিকিউশনের ১৫তম সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ঘটনার সময় তিনি বেরোবিতে দায়িত্বরত ছিলেন।
এদিন এই মামলায় প্রসিকিউশনের ১৪তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশের এসআই মো. আশরাফুল ইসলাম। তিনি তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘পুলিশের এসি আরিফুজ্জামান স্যার ও তাজহাট থানার ওসি রবিউল ইসলাম স্যারের নির্দেশে শটগান ইস্যুকৃত পুলিশ সদস্যরা ফায়ার করতে করতে গেটের বাহিরের দিকে যায়। দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ছাত্রের গায়ে গুলি লাগে।’ পরে এই দুই সাক্ষীকে জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। এই জেরা শেষে আরও সাক্ষী উপস্থাপনের জন্য আজকের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। এদিকে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলামের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ প্রসিকিউশনের ২৬তম ও শেষ সাক্ষী হিসেবে তিনি জবানবন্দি দিচ্ছেন। তার অসমাপ্ত জবানবন্দি গ্রহণের জন্য আজ পুনরায় দিন রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে গতকাল এই মামলার ২৫তম সাক্ষী হিসেবে জাবনবন্দি দেন কামরুল হাসান। তিনি জব্দতালিকার সাক্ষী। সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ এই মামলার মোট আসামি আটজন।
অন্যদিকে এক যুগ আগে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যা-নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের বিষয়ে দুই মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১২ জানুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সময়কার পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
এসি-ওসির নির্দেশে শটগানের গুলি : ৪৭ বছর বয়সি পুলিশের এসআই মো. আশরাফুল ইসলাম বর্তমানে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, গত বছর ১৬ জুলাই রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইনসে কর্মরত ছিলেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আনুমানিক ১টার দিকে রংপুর শহরের লালবাগ থেকে ছাত্র-জনতার একটি মিছিল আসে। তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোতোয়ালি জোনের এসি মো. আরিফুজ্জামান, এডিসি ডিবি মো. শাহ নুর আলম পাটোয়ারী ও তাজহাট থানার ওসি মো. রবিউল ইসলাম উপস্থিত সব পুলিশ সদস্যের বেরোবির ১ নম্বর গেটের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে দেন। লালবাগ থেকে আগত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটে প্রবেশ করতে চাইলে এসি আরিফুজ্জামান স্যার ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে বাধা প্রদান করেন। একপর্যায়ে ছাত্রদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা সৃষ্টি হয়। এরপর উপস্থিত সব ফোর্সকে এসি আরিফুজ্জামান স্যার হুইসেল ও লাঠিচার্জ এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন।’
জবানবন্দিতে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘লাঠিচার্জ এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হলে ছাত্র-জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা সিভিল পোশাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কতিপয় সদস্য অবস্থান নিলে ছাত্র-জনতা আরও উত্তেজিত হয়। এরপর এসি আরিফুজ্জামান স্যার পুলিশ সদস্যদের মধ্যে গ্যাসগান ইস্যুকৃত সদস্যদের গ্যাস ফায়ারের নির্দেশ দেন। এসি আরিফুজ্জামান নিজেও গ্যাসগান ফায়ার করেন। গ্যাসগান ফায়ার করলে ছাত্র-জনতা আবার ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরক্ষণে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের নিয়ে এসি আরিফুজ্জামান স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের ভিতরে চলে যান। কিছু সময় পরে ছাত্র-জনতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট ধাক্কাধাক্কি করে খুলে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করে।’
তিনি বলেন, ‘এ সময় এসি আরিফুজ্জামান স্যার, তাজহাট থানার ওসি রবিউল ইসলাম ও এডিসি ডিবি শাহ নুর আলম পাটোয়ারী পুলিশ সদস্যদের সামনের দিকে ডাকেন এবং শটগান ফায়ার করতে বলেন। এসি আরিফুজ্জামান স্যার ও ওসি রবিউল ইসলাম স্যারের নির্দেশে শটগান ইস্যুকৃত পুলিশ সদস্যরা ফায়ার করতে করতে গেটের বাহিরের দিকে যায়। শটগান ফায়ার করলে রাস্তায় দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ছাত্রের গায়ে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ ছাত্র অসুস্থ হয়ে সেখানে পড়লে আশপাশে কয়েকজন ছাত্র তাকে ধরাধরি করে চিকিৎসার উদ্দেশে নিয়ে যায়। এ সময় ছাত্র-জনতার ওপর পুনরায় এসি আরিফুজ্জামান স্যার গ্যাসগান ফায়ার করেন।’
ঢিল ছোড়ে শিক্ষক-কর্মচারীরাও : রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত এএসআই মো. আবদুল্লাহ আল নাছির গত বছর ১৬ জুলাই দায়িত্ব পালন করেছিলেন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই সময় রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইনে কর্মরত ছিলেন। ৩৮ বছর বয়সি এই পুলিশ কর্মকর্তা গতকাল তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর ১৬ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শহরের মেডিকেল মোড়ে অবস্থান নেই। বেলা আনুমানিক দেড়টা থেকে পৌনে ২টার দিকে বেতার কন্ট্রোল থেকে নির্দেশনা পেয়ে আনুমানিক ২টার দিকে বেরোবি ১ নম্বর গেটের সামনে পৌঁছাই। এরপর আমি সেখানে গিয়ে দেখি পুলিশের ধাওয়ায় ছাত্ররা পালিয়ে গেছে। সেখানে এসি কোতোয়ালি জোন আরিফুজ্জামান স্যারসহ কয়েকজনকে গ্যাসগান ফায়ার করতে দেখি। পরে ১ নম্বর গেটের অপর পাশে কাঠেরপুল নামক স্থানে এসি আরিফুজ্জামান স্যারসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য একজন ছাত্রকে মারধর করতে দেখি।’
জবানবন্দিতে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে সব পুলিশ সদস্য ১ নম্বর গেটের ভিতরে চলে আসে এবং গেট বন্ধ করে দেয়। এর একটু পরে এডিসি ডিবি শাহ নুর আলম পাটোয়ারী স্যারসহ তার সঙ্গে থাকা অফিসার ও ফোর্স নিয়ে ১ নম্বর গেটের ভিতরে প্রবেশ করেন। ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মশিউর রহমান এবং সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান ও সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী হাফিজুর রহমান, নুরুন্নবীসহ অনেককেই পুলিশের পাশে অবস্থান নিয়ে গেটের অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্র-জনতার দিকে ঢিল ছুড়তে দেখি।’