সম্পর্কে বিশ্বাসের ঘাটতি, পরকীয়া কিংবা তুচ্ছ স্বার্থের দ্বন্দ্বে স্বামী কেড়ে নিচ্ছেন স্ত্রীর প্রাণ। কিংবা প্রেমিককে নিয়ে স্বামীর হন্তারক হয়ে উঠছেন স্ত্রী। সম্পত্তি নিয়ে বাবা-ছেলের দ্বন্দ্ব, ভাইয়ে-ভাইয়ে হানাহানি যেন নিত্যদিনের ঘটনা। আর তুচ্ছ এসব ঘটনায় সিলেটে স্বজনরা হয়ে উঠছে ‘ঘাতক’। সামান্য স্বার্থের কারণে একজন কেড়ে নিচ্ছেন অন্যজনের প্রাণ। গত দেড় মাসে সিলেটে স্বজনদের হাতে খুনাখুনির এমন ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২০টি। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়া এবং দিনদিন মানুষের মধ্যে স্বেচ্ছাচারী মনোভাব তৈরির কারণে এমন ঘটনা বাড়ছে বলে মন্তব্য করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
৯ নভেম্বর মাধবপুর উপজেলার সম্পদপুর গ্রাম থেকে দুই সন্তানের জননী সানজিদা আক্তার নিপার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সানজিদার বাবার অভিযোগ, স্বামী রফিকুল ইসলাম গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করার পর সানজিদার ওপর শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। বাবার দাবি, রফিকুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে সানজিদাকে খুন করেছেন। ৩ নভেম্বর একই উপজেলার করড়া গ্রামের রাজন মিয়া স্ত্রী শাপলা আক্তারকে হত্যা করে লাশ বালুচাপা দিয়ে রাখেন। পরদিন আদালতে গিয়ে তিনি হত্যার দায় স্বীকার করেন। তাঁর দাবি, স্ত্রী পরকীয়ায় লিপ্ত হওয়ায় তিনি খুন করেছেন।
ছাতকে সৎ-দেবরের সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে স্বামীকে খুন করার অভিযোগ উঠেছে রানু বেগমের বিরুদ্ধে। ৭ নভেম্বর ওই গৃহবধূকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, স্বামী জিয়াউর রহমানের সৎভাই বাবুল মিয়ার সঙ্গে রানু বেগমের পরকীয়া ছিল। বাবুল মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীকে খুন করে বাড়ির পাশের একটি খালে বস্তাবন্দি লাশ ফেলে দেন। ৩১ অক্টোবর দক্ষিণ সুরমার তেলিরাইর বাড়ির ছাদ থেকে উদ্ধার করা হয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুর রাজ্জাকের ক্ষতবিক্ষত লাশ। পরিবার ঘটনাটি আত্মহত্যা দাবি করে অপমৃত্যু মামলা করতে চাইলে পুিলশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা করে। ওই মামলায় তাঁর একমাত্র ছেলে আসাদ আহমদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, পারিবারিক বিরোধের জেরে স্বজনদের হাতেই খুন হয়েছেন আবদুর রাজ্জাক। ২৭ অক্টোবর নবীগঞ্জের কুড়িশাইল গ্রামে স্বামীপরিত্যক্তা মেয়েকে বঁটির আঘাতে খুন করেন বাবা। পূর্ণিমা রানী দাশ নামের ওই তরুণী এক তরুণের সঙ্গে ঢাকায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। কয়েক দিন পর বাড়ি ফিরে এলে এলাকার লোকজন নানান কটূক্তি করতে থাকে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাবা মতিলাল দাশ মেয়েকে খুন করেন। ১৭ অক্টোবর দোয়ারাবাজার উপজেলার রাঙ্গারচর থেকে ফারুক আহমদ নামে মধ্যপ্রাচ্যফেরত এক প্রবাসীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি জানিয়েছেন, পরকীয়া সন্দেহে ১৪ অক্টোবর বিকালে সিলেটের লাক্কাতুড়া বাগানের একটি জঙ্গলে নিয়ে তাঁর স্ত্রী রাবেয়া বেগমকে খুন করে লাশ ফেলে আসেন। ৬ অক্টোবর সুনামগঞ্জে আদালতপ্রাঙ্গণে স্বামী আখতার হোসেনের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান শরিফা আক্তার। তিনি ধর্মপাশা উপজেলার কান্দাপাড়া গ্রামের হেকিম মির্জার মেয়ে। ৪ অক্টোবর গোলাপগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে স্বামী রেজাউল করিমের হাতে খুন হন সাহিদা বেগম। পারিবারিক কলহের জেরে এসব হত্যাকা ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ফখরুল আলম বলেন, ‘একসময় দেশে যৌথ পরিবারের প্রচলন ছিল। পরিবার ও সমাজে প্রবীণদের শাসন ছিল। কিন্তু পরিবার ও সমাজজীবনে এর পরিবর্তন ঘটেছে। এখন যৌথ পরিবার প্রথা কমে এসেছে। আমরা দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে বাস করছি। অস্থির সমাজমাধ্যম, ভোগবাদ, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় স্বেচ্ছাচারী করে তুলছে। মানুষ একে অন্যের কথা শুনতে ও বুঝতে চায় না। ফলে ভালোবাসার জায়গা দখলে নিচ্ছে অবিশ্বাস, ক্ষোভ ও স্বার্থ। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পারিবারিক সম্পর্কে ভাঙন, সামাজিক একাকিত্ব, মানসিক অস্থিরতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, আইনের দুর্বল প্রয়োগ, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও মূল্যবোধের অবক্ষয় এসবের জন্য দায়ী।’