রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার : সমস্যা ও সমাধান

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার : সমস্যা ও সমাধান
ইংরেজি ভাষা আমাদের রক্তের মধ্যে কিছু কিছু আসর করেছে সন্দেহ নেই এবং ইংরেজি ভাষা আমাদের পরিভাষার প্রয়োজন সেটাও বুঝি, কিন্তু এ পরিভাষার জন্য যদি চিন্তা করি, হয়তো বাংলা ভাষা হবে না। সে জন্যই আমরা শাসনতন্ত্রে কোনো ভাষা মিডিয়া রাখিনি যে পাঁচ বছরে, দশ বছরের মধ্যে ইংরেজি থেকে বাংলায় পৌঁছতে হবে। আপনারা চেষ্টা করুন যেভাবে আপনাদের ভাষা আসে তার মধ্য থেকেই জাজমেন্ট লেখার চেষ্টা করুন

[পূর্ব প্রকাশের পর]

১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদের বিধানকে পূর্ণরূপে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ প্রণীত হয়। এতে বলা হয়- (১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্র্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্য অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে;

(২) কোনো সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মস্থলের কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তা হলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে;

(৩) যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন, তা হলে ওই কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে; এবং (৪) সরকার সরকারি গেজেটে বিজ্ঞপ্তি দ্বারা এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিধি প্রণয়ন করতে পারবে।

১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মে অফিস-আদালত বাংলা ভাষা ব্যবহার সংক্রান্ত সচিব কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত আরও কিছু নতুন ইংরেজি বাংলা পরিভাষা সমন্বয়ে ‘প্রশাসনিক পরিভাষা প্রথম সংস্করণ (সংযোজিত)’ জারি করে। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ সব নতুন আইন, অধ্যাদেশ, বিধি প্রভৃতি বাংলায় প্রণয়ন করতে হবে এই মর্মে একটি আদেশ জারি করে। এতে বলা হয়, সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে জারিকৃত সরকারি কাজের সব স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের কর্মসূচি-১ম পর্যায়ের নির্দেশ ১০-এ উল্লেখ ছিল- ‘এখন হতে যথাসাধ্য সকল নতুন আইন, অধ্যাদেশ, বিধি প্রভৃতি বাংলায় প্রণীত হবে।’ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ জারির পরিপ্রক্ষিতে বর্তমানে আর কোনো নতুন আইন, অধ্যাদেশ, বিধি প্রভৃতি ইংরেজিতে প্রণয়নের অবকাশ নেই। তথাপি কোনো কোনো মন্ত্রণালয় থেকে ইংরেজিতে আইন/বিধি জারির উদ্দেশে এ মন্ত্রণালয়ের অনুমতির জন্য প্রস্তাব পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, ভবিষ্যতে সব নতুন আইন, অধ্যাদেশ, বিধি ইত্যাদি অবশ্যই বাংলায় প্রণয়ন করতে হবে।

প্রায় প্রতি বছরই বাংলা ভাষায় দাফতরিক কার্যাবলি চলবে মর্মে বহু পরিপত্র জারি করা হয়। বহু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর মধ্যে একটি সিদ্ধান্ত হলো বাংলা একাডেমির অর্ডিন্যান্স রহিত করে ‘বাংলা একাডেমি, ২০১৩ আইন’ যা জাতীয় সংসদে পাস হয়। বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩-এ বাংলা একাডেমির কার্যাবলি ধারা ১০-এর উপধারা ১-এ বলা হয়, ‘জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়ন, লালন ও প্রসার সাধন। এ আইনে পরিবর্তনশীল ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে বাংলা ভাষার গৌরবময় ঐতিহ্য সমুন্নত রেখে সর্বস্তরে এবং জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন, ব্যবহার ও বিকাশের কথা বলা হয়েছে। বাংলা ভাষার প্রামাণ্য অভিধান, পরিভাষা ও ব্যাকরণ রচনা, রেফারে›স গ্রন্থ, গ্রন্থপঞ্জি এবং বাংলা ভাষার বিশ্বকোষ প্রণয়ন ও সহজলভ্যকরণের বিষয়টিও এই আইনে রয়েছে।

বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ আরও যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা হলো বাংলা শব্দের প্রমিত বানান ও উচ্চারণ নির্ধারণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ, বাংলা ভাষায় উচ্চতর পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক রচনা করা; অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য বাংলা ভাষার অগ্রাধিকার; আধুনিক ও ডিজিটাল প্রযুক্তিসম্পন্ন গ্রন্থাগার এবং  বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন, বাংলা বানানরীতি ও ব্যবহার সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা।

২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন-২ শাখা থেকে ‘আইনের খসড়া প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভাষাগত উৎকর্ষ, বিষয়গত যথার্থতা এবং সংশ্লিষ্ট অপরাপর আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য ও সংগতি বিধানের লক্ষ্যে অনুসরণীয় রূপরেখা’ জারি হয়। এই রূপরেখার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হলো, উদ্যোগী মন্ত্রণালয়/বিভাগ আইনের খসড়া প্রণয়ন করবে; খসড়া দাখিলের আগে উদ্যোগী মন্ত্রণালয় বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ কর্র্তৃক ভাষার যথার্থতা প্রমিতকরণ করবে; আইনের ভাষা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সাধু ভাষারীতি অনুসরণ করতে হবে; সংবিধানের ভাষারীতির মান অনুসরণীয় এবং সমীচীন শব্দ চয়ন; আইনের খসড়ায় ইংরেজি শব্দ যথাসম্ভব পরিহার করে প্রমিত বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে হবে, তবে টেকনিক্যাল শব্দগুলো ইংরেজিতে লেখা যেতে পারে; আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিরাম চিহ্নের ব্যবহার সঠিকভাবে করতে হবে।

বাংলাভাষাকে কীভাবে আইন অঙ্গনে অধিক ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায় সে লক্ষ্যে সরকার সদাসর্বদা কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা যারা উচ্চতর আদালতে বিচারক হিসেবে কর্মরত আছি আদালতের কার্যক্রম বিশেষ করে সওয়াল জবাব ও যুক্তিতর্ক ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও গ্রহণ করি। তবে সমস্যা হয় প্রতিশব্দ প্রাপ্তির। আইনজীবীগণ প্রায়শই বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণে তাদের বক্তব্য রাখেন। তবে দুই ভাষার মিশ্রণে রায় লেখাটা শোভন ও সম্ভব হয় না। যে কোনো একটি ভাষাতেই  রায় লিখতে হয়। এ জন্য আইন অঙ্গনে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহারে যে বাস্তব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

১৮ ডিসে¤¦র ১৯৭২ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধনকালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির একটি সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ইংরেজি ভাষা আমাদের রক্তের মধ্যে কিছু কিছু আসর করেছে সন্দেহ নেই এবং ইংরেজি ভাষা আমাদের পরিভাষার প্রয়োজন সেটাও বুঝি, কিন্তু এ পরিভাষার জন্য যদি চিন্তা করি, হয়তো বাংলা ভাষা হবে না। সে জন্যই আমরা শাসনতন্ত্রে কোনো ভাষা মিডিয়া রাখিনি যে পাঁচ বছরে, দশ বছরের মধ্যে ইংরেজি থেকে বাংলায় পৌঁছতে হবে। আপনারা চেষ্টা করুন যেভাবে আপনাদের ভাষা আসে তার মধ্য থেকেই জাজমেন্ট লেখার চেষ্টা করুন। এভাবেই যা শেষ পর্যন্ত ভাষায় পরিণত হয়ে যাবে। আমরা আর পরিভাষা কমিটি করার কথা চিন্তা করছি না।

বঙ্গবন্ধু  আরও বলেছেন- অল্প কথায় লিখুন, যতটুকু পারা যায়, লেখা যায়, আমরাও চেষ্টা করতেছি, আমাদেরও অসুবিধা হয়ে যায়, আমরাও মাঝে মধ্যে অসুবিধা ফিল করি, এই যে ফিল করি বলে ফেললাম, হয়ে যায়, আমাদেরও হয়। কিন্তু আমরা চেষ্টা করতেছি আর কিছু না পারি যখন ইংরেজি লেইখ্যা নিয়া আসে এইটা বাংলায় সাইন করে দিই।

গত ১৬ ফেব্র“য়ারি ২০২০, কবি হেলাল হাফিজের একটি বক্তব্য প্রকাশিত  হয়েছে দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ এর প্রথম পৃষ্ঠার বামের কলামে। তিনি বলেছিলেন, ‘অনুবাদের একটি একাডেমি খুবই দরকার।’ তিনি বিস্তারিত বলতে গিয়ে বলেছেন, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিপক্ষে একটা প্রতিপক্ষ তখন তৈরি হচ্ছিল। এখনো বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অনেক চক্রান্ত আছে। সেখানে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। অন্য কোনো ভাষা যেন আমাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ না করে। আমরা যেন আমাদের ভাষাকে সুন্দরভাবে লালন-পালন করি। একটা সুন্দর, মার্জিত, রুচিসম্পন্ন প্রমিত ভাষা যেন তৈরি হয় আমাদের।

ভাষা নিজে তো নির্বাক। মানুষ এটাকে ব্যবহার করে সচল রাখে। আমাদের দায়িত্ব এ ভাষাটাকে প্রাঞ্জল করা, এটিকে আরও শক্তিদান করা। আমাদের সাহিত্য, গান, কবিতা, উপন্যাসের মাধ্যমে তা করতে হবে। ব্যবহারিক জীবনেও করতে হবে। বাংলা সাহিত্যে অনেক ভালো ভালো লেখা আছে। সেগুলো বিশ্বদরবারে আমরা পৌঁছতে পারছি না শুধু ভাষাটা বাংলা বলে। এ জন্য আমাদের মানসম্মত সাহিত্যগুলোকে একাধিক বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। এটা বাংলা একাডেমি করতে পারে। অনুবাদের জন্য আলাদা একাডেমিও হতে পারে। এটা খুবই দরকার। না হলে আমরা যত ভালোই লিখি না কেন, তা বিশ্ব দরবারে পৌঁছবে না। পাশাপাশি পৃথিবীর অন্য ভাষার উন্নত সাহিত্যকর্মকেও আমাদের জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। বিস্তৃত পরিসরে জ্ঞান অর্জনের জন্য এটি করতে হবে। শুধু এ কাজের জন্যই একটা একাডেমি প্রয়োজন।

সব কিছু বিবেচনায় আমি অনুভব করি প্রত্যেক বিচারকের মনে এমন সংকল্প থাকা প্রয়োজন যে, আমরা প্রত্যেকেই বাংলা ভাষায় রায় লিখব। তবে যে রায়গুলোয় আন্তর্জাতিক আবেদন থাকতে পারে বলে বিচারক মনে করবেন সেক্ষেত্রে বিচারকের  স্বাধীনতা থাকা উচিত যে তিনি ইংরেজি বা বাংলা যে কোনো ভাষায় তার রায়টি লিখবেন। আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সব রায় ইংরেজি ভাষায় লিখিত। বেশ কষ্ট হলেও বাংলা ভাষায় লেখা যেত। কিন্তু এখানে বিচারাধীন অপরাধ সংশ্লিষ্ট বিবর্তিত আইন বিজ্ঞান ইংরেজি ভাষায়। একই সঙ্গে বিশেষ এই বিচারিক প্রতিষ্ঠানের রায় ও কার্যক্রমের প্রতি বৈশ্বিক দৃষ্টি রয়েছে। দেশের বিচার ব্যবস্থার মান তুলে ধরার বিষয়টিও এখানে মনে রাখতে হয়েছে। সে জন্যই বাংলায় রায় লেখা একেবারে অসম্ভব না হলেও এবং বাংলা ভাষায় রায় অনুবাদের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় রায়গুলো ইংরেজি ভাষাতেই লেখা হয়েছে।

ভারতে বর্তমানে তাদের সুপ্রিম কোর্টের রায়গুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ২২টির মধ্যে ৯টি (নয়) ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্টের রায় প্রদানে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক তাই তারা এই অনুবাদের ব্যবস্থা নিয়েছেন। যতটুকু জানা যায় AI (Arificial Intellegence) বা MT (Machine Technology)-এর সাহায্য নেওয়া হচ্ছে এই অনুবাদ প্রক্রিয়ায়। এরূপ অনুবাদের ব্যবস্থা সুদূর অতীতে কলকাতা হাই কোর্টেও ছিল। ১৮৬২ সালে কলকাতা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৮৬৭ সালের গোড়ার দিকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত সদ্য ব্যারিস্টারি পাস করে কলকাতা হাই কোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। কিন্তু পেশায় তেমন কোনো সাফল্য আসেনি। তাই তিনি ১৮৭০ সালে আইন পেশা ছেড়ে মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে কলকাতা হাই কোর্টের অনুবাদ বিভাগের পরীক্ষকের চাকরি গ্রহণ করেন। এটি থেকে দেখা যায়, কলকাতা হাই কোর্টে একটি অনুবাদ বিভাগ হাই কোর্ট সৃষ্টির গোড়া থেকেই ছিল।

বলা হতে পারে যে, কলকাতা হাইকোর্ট ছিল ব্রিটিশ রাজ্যের অধীন। ভারতে সরকারি ভাষা ছিল ইংরেজি তাই তখন অনুবাদ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা ছিল। বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রের ভাষা যেহেতু বাংলা তাই এখানে আবার কেন অনুবাদ কেন্দ্রের প্রয়োজন? যেহেতু, পূর্ববর্তী স্তবকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোন রায়ের আন্তর্জাতিক আবেদন রয়েছে বলে যদি বিচারক মনে করেন তা হলে তিনি ইংরেজি ভাষায় রায় লিখতে পারেন। তবে বাংলায় রায় লিখলে তখন অনুবাদ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অনিবার্যভাবে সামনে এসে যায়।

আমাদের সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে যদি ভালো কোনো অনুবাদের একটি ব্যবস্থা থাকে তাহলে ইংরেজি ভাষায় লেখা যে রায়সমূহ বাংলায় অনূদিত হওয়া উচিত বলে বিচারপতিগণ মনে করবেন শুধু সেগুলো অনুবাদ করা যেতে পারে। আবার এটি এভাবে হতে পারে, যেমন একজন বিচারক একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ রায় দিলেন বাংলায় এবং তিনি যদি মনে করেন এ রায়টিতে কোনো নতুন নজির বিবর্তিত হয়েছে যা আন্তর্জাতিক আইন বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে তবে তিনি এ রায়টি ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য অনুবাদ কেন্দ্রে পাঠাতে পারেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিচারককে তাঁর রায়ের শেষে রায়টির গুরুত্ব উল্লেখপূর্বক একটি স্তবক লিখে তা অনুবাদের জন্য সনদ (সার্টিফিকেট) দিতে পারেন। অনুরূপভাবে যদি কোনো বিচারক ইংরেজিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রদান করেন এবং যদি তাঁর বিবেচনায় দেশের আপামর জনসাধারণের বোঝার জন্য এ রায়টির বঙ্গানুবাদ হওয়া প্রয়োজন তবে তিনি পূর্বোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে তা অনুবাদ কেন্দ্রে পাঠাতে পারেন। এতে উচ্চ আদালতের রায় যেমন বাংলায় পাওয়া যাবে ঠিক তেমনি বাংলায় প্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলোও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের পাঠকগণ অনূদিত ভাষায় পড়ে আমাদের বিচার ব্যবস্থা এবং এর মান সম্বন্ধে সম্যক ধারণা পাবেন।

ভাষান্তর করে রায় অনুবাদের এ ব্যবস্থা নেওয়ার পরও কিছু সমস্যা থেকে যেতে পারে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাণিজ্য চুক্তিসমূহ বাস্তবায়নের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীর একশত নব্বইটি দেশের মধ্যে একশত ঊননব্বইতম। এ ধরনের বাণিজ্যিক চুক্তি পৃথিবীর অনেক দেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সঙ্গে হয়ে থাকে। দেশের বেকারত্ব দূরীকরণের অন্যতম প্রধান ব্যবস্থা হচ্ছে বিনিয়োগ। বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। যদি বিদেশি বিনিয়োগ দেশে না আসে তাহলে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যাপ্তি কমে যাবে। এর ফলে বেকারত্ব বেড়ে যাবে। তাই এ ধরনের বৈদেশিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পর্কিত কোনো বিরোধ সংশ্লিষ্ট মামলায় অবশ্যই রায় লিখতে হবে এমন এক ভাষায় যাতে এর মর্র্মার্থ সহজেই সব পক্ষগণের কাছে বোধগম্য হয়। এমন বিরোধ উ™ভূত কোনো মামলায় আদালতের রায় ইংরেজিতে হতেই পারে এবং এটাই হওয়া স্বাভাবিক। তবে ইংরেজিতে লেখা এমন রায়ের বাংলা অনুবাদ চাইলে পূর্বে উল্লিখিত পদ্ধতিতে তা করা যেতে পারে। দেশের সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় রায় লেখাটা অবশ্যই একটি মহৎ উদ্যোগ যা একজন বিচারকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আগেই উল্লেখ করেছি, বৈশ্বিক বিচার ব্যবস্থার মানের বিষয়টিকে মাথায় রেখে ভালো রায় প্রদানের ক্ষেত্রে কোনোরূপ আপস করার সুযোগ নেই। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়েই আমি প্রদত্ত রায়ের অনুবাদ ব্যবস্থার ধারণাটির কথা উল্লেখ করলাম।

১৯৫২ সালে মাতৃভাষার দাবিতে রক্তদানের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার যে বীজ বপন করা হয়েছিল তা কালক্রমে ১৯৫৪-এর নির্বাচন, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৬৯-এর সংগ্রাম ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এক বিরাট মহীরুহতে পরিণত হয়েছে। আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না যে, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অগ্রজরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ের্ছিলেন। ১৯৫২ সাল থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত বাঙালিদের সার্বজনীন স্লোগান ছিল ‘তুমি কে আমি কে- বাঙালি বাঙালি’ তোমার আমার ঠিকানা ‘পদ¥া মেঘনা যমুনা। এসব চেতনা সমৃদ্ধ স্লোগান ছিল বাংলায়। জাতির জনক জাতিসংঘে প্রথম বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন। বাংলা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ যখন জন্মলাভ করল তখন তার জনক বঙ্গবন্ধু দৃঢ় আহ্বান জানালেন রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বত্র বাংলা চালু করার। ১৮ ডিসে¤¦র ১৯৭২ সালে সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পড়লে দেখা যায় তিনি কতটা বাস্তববাদী এবং সহনশীল ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আপনারা চেষ্টা করুন যেভাবে আপনাদের ভাষা আসে তার মধ্য থেকেই জাজমেন্ট লেখার চেষ্টা করবেন। এভাবেই যা শেষ পর্যন্ত ভাষায় পরিণত হয়ে যাবে।’

সবশেষে মাতৃভাষার প্রতি অদম্য প্রাণের টানেই বলছি- আসুন আমরা সব বিচারক বাংলা ভাষায় রায় লিখতে চেষ্টা করি। তবে তা অবশ্যই হতে হবে ভালো, প্রজ্ঞাপূর্ণ ও যৌক্তিক রায়। পাশাপাশি বাংলা ভাষায় এবং ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত রায়ের অনুবাদের ব্যবস্থাও যেন থাকে সে বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেবেন বলে বিনম্র প্রত্যাশা করছি।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর