শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মুক্তির সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

মুক্তির সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মই হয়েছে রক্তের সমুদ্র অতিক্রম করে, ভয়ানক রক্তক্ষয়ী এক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। সে যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি ঠিকই; কিন্তু আমাদের মুক্তি আসেনি, স্বাধীনতাও আসেনি। স্বাধীনতা এসেছে কতিপয়ের, যা ইচ্ছা করার, বাকিরা বন্দী হয়ে আছে। কেবল যে অভাব ও নিষ্পেষণের হাতে তা নয়, হতাশার হাতেও। মুক্তিযুদ্ধ কেবল যে কিছু পশুর বিরুদ্ধে ছিল, তা তো নয়। ছিল পশুত্বের বিরুদ্ধেই। আমরাও চেয়েছিলাম দস্যুতার অবসান ঘটবে। শোষণ থাকবে না। অন্তত মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো মিটবে। আর কেউ লাঞ্ছিত হবে না। কেউ কাঁদবে না। কেউ আশ্রয়হীন হবে না। স্বপ্ন ছিল অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার। স্বপ্ন ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সমাজ এবং শেষ পর্যন্ত একটি সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার। সে কাজে আমরা সফল হইনি। আমরা একদল পশুকে হাঁকিয়ে দিয়েছি ঠিকই; কিন্তু পশুত্বকে পরাভূত করতে পারিনি। পারিনি যে তার নানা প্রমাণ ও লক্ষণ বিদ্যমান। আমরা যথাসময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারিনি। উল্টো রাষ্ট্র পরিচালনায় সঙ্গী করে শত্রুকে নিজ ঘরে শেকড় গড়তেই শক্তি জুগিয়েছি দিনের পর দিন। আজ তারা দৌরাত্ম্য করছে। প্রবল হয়ে উঠেছে মৌলবাদ।

বাংলাদেশে মৌলবাদ যে গলা ছাড়ছে তার কারণ হচ্ছে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ধারক ও বাহকরা জনগণকে মুক্তির দিকে না নিয়ে গিয়ে বরং নরকের ভিতর নিয়ে এসেছে। ওদিকে বামপন্থিরাও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। একের ব্যর্থতা এবং অন্যের অনুপস্থিতি— এ দুইয়ের ফাঁকেই মৌলবাদের হাঁকডাক। তাছাড়া বিশ্বজুড়েই তো পুঁজিবাদের ব্যর্থতায় মৌলবাদ নতুন শক্তি পাচ্ছে। যদি বেছে নিতে হয় তবে পুঁজিবাদীরা মৌলবাদকেই বেছে নেবে, সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে। কারণটা সহজ। কারণ হচ্ছে, সমাজতন্ত্র তার সামনে যে ধরনের চ্যালেঞ্জ উপস্থিত করে, মৌলবাদ তেমনটি করে না। মৌলবাদও প্রতিষ্ঠিত স্বার্থ ও ব্যবস্থার সমর্থক বটে, পুঁজিবাদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বটা বৈরী নয়, অবৈরী।

আমাদের দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। একের পর এক সামরিক শাসনের অধীনে ছিলাম আমরা। তারপরও নির্বাচিত সরকার পেলাম ঠিক, কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার পেলাম কি? আগের সরকার গণতান্ত্রিক ছিল না, এ সরকারও নয়। অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকবে দিন দিন। দেশ চলবে না, সচল থাকবে শুধু নৈরাজ্য। নরক তখন আরও বাস্তবিক হয়ে উঠবে।

একটি বিস্ফোরণ কি অত্যাসন্ন? তা বোধকরি না। বিস্ফোরণ ঘটবে না, প্রচণ্ড আওয়াজ হবে না; তবে ধীরে ধীরে সব কিছু নারকীয় রূপ নেবে। যে নৈরাজ্য দেখা দেবে তাকে কোনো সরকারই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে না। এ সরকার ব্যর্থ যারা বলছে তারাও ব্যর্থ হবে, যদি তারা ক্ষমতায় আসে। অবস্থা তখন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এদের দিয়ে উন্নতি হয়েছে, তবে সেটি একটি বিশেষ ধরনের। পেছনে একটা দর্শন রয়েছে। একটি আদর্শ। আদর্শটা হলো এই যে, উন্নতি হবে একটি বিশেষ শ্রেণির। মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত হবে, মধ্যবিত্তের একাংশ নেমে যাবে নিচে, মিশে যাবে সেই বিপুল জনস্রোতের সঙ্গে, উন্নতি যাদের স্পর্শ করতে পারেনি। তবে বাস্তবতাও এটা যে, যারা উন্নত হয়েছে তারাও স্বস্তিতে নেই। দরজায় দরজায় পাহারা।

আসলে উন্নতির পাল্টা আদর্শ প্রয়োজন। কোন আদর্শ? এককথায় বলা যাবে, গণতান্ত্রিক আদর্শ। সবাই জানেন গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট নয়। ভোট গণতন্ত্রের একটা অংশ মাত্র, একটি পদ্ধতি। লোকে রায় দেবে, পছন্দ-অপছন্দ জানাবে— এটা না থাকলে গণতন্ত্র থাকে না। কিন্তু নির্বাচিত সরকারও তো স্বৈরাচারী হতে পারে। আমরা জানি তা হয়েছেও। এই হচ্ছে বৈধ স্বৈরাচার। এ কম ভয়ঙ্কর নয় অবৈধ স্বৈরাচারের তুলনায়। এখানে আমাদের ব্যবস্থায় নির্বাচন মানে দুজন ধনীর মধ্যে কাকে সুযোগ দেব। আরও ধনী হতে, সেটা নির্ধারণ করে দেওয়া। কিন্তু আসলে তারা একই ধরনের পুঁজিবাদী উন্নতিতে বিশ্বাসী। গণতন্ত্র তাই ভোট নয়, ভোটের চেয়ে অনেক বড় একটা ব্যাপার। গণতন্ত্র হচ্ছে অধিকার ও সুযোগের সাম্য। এই সাম্য উদ্দেশ্যবিহীন নয়। এর উদ্দেশ্য নয় ধনীকে বিপদে ফেলা, এর উদ্দেশ্য জীবনের সমষ্টিগত মানকে উন্নত করা। তেমন ব্যবস্থা তৈরি করা, চিকিৎসা যাতে দেশেই পাওয়া সম্ভব হয় এবং ভালো চিকিৎসা সবাই পায়। যানজট দূর হবে, পরিবেশ হবে বিষযুক্ত। মেয়েরা পাবে অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা। কারও জন্যই অভাব থাকবে না নিরাপত্তার।

ওই উন্নতিই চেয়েছে মানুষ। তার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। ব্রিটিশ যুগে এবং সে যুগেরও আগে। পাকিস্তান আমলেও। লড়াই করছে এখনো। এ দেশের মানুষ আত্মসমর্পণ করেনি, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। পথ আসলে সেটাই। আমাদের এ প্রতিরোধের ঐক্যই প্রয়োজন হবে। কিন্তু এখন ওই প্রতিরোধটা নেই, লুণ্ঠন ঠিকই রয়েছে। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অপরাধীর নাম-ঠিকানা বদল হয়েছে; কিন্তু অপরাধ শেষ হয়নি। অপরাধী এখন স্বদেশেই, সে স্থানীয়। ছড়িয়ে গেছে। সে ধরা পড়ে না। কে ধরবে? প্রত্যেকই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। আর ধরা পড়ে যখন-তখনও শাস্তি হয় না। তার জোর আছে। সবচেয়ে বড় জোর টাকার। ব্যবসায়ী, আমলা, বেকার যুবক, রাজনীতি-লুণ্ঠনকারী আজ কে নয়/কার জিহ্বা সিক্ত নয় লালসায়? চোখ নয় লোভের আগুনে জ্বলন্ত? সব মানুষের মধ্যেই পশু আছে, পশুই প্রাথমিক এবং মানুষ মাত্রই স্বার্থপর। কিন্তু পশুত্বের কারণে মানুষ মানুষ হয়নি, মনুষ্যত্বের কারণেই হয়েছে। এ মনুষ্যত্বকে বিকশিত করা এবং তাকে রক্ষা করার যে কাজ সেটা সহজ নয়। খুবই কঠিন। এ কাজ কেউ একা করতে পারে না, সাহায্য-সহযোগিতা, সমর্থন ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। এ মনুষ্যত্বের জন্য চাই অনুকূল রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রটা মানুষের। এই যে হাজার হাজার তরুণ এখন বেকার, লাখ লাখ শিশু-কিশোর ভবিষ্যত্হীন অন্ধকারে নির্লিপ্ত। অপরাধ বাড়ছে, বাড়ছে দরিদ্রের সংখ্যা। শিক্ষা ব্যবস্থা সুবিধাবাদী প্রাণীর প্রস্তুতি সম্ভব করছে, মানুষ তৈরি করছে না। বিচ্ছিন্ন হচ্ছে মানুষ একে অপরের থেকে। কিন্তু এত সব হতাশার মধ্যে আশাও আছে। অতীতে আমরা আত্মসমর্পণ করিনি, ভবিষ্যতেও করব না। মুক্তিযুদ্ধ একাত্তরে শুরু হয়নি। শেষও হয়নি। একাত্তরে তার একটা পর্ব শেষ হয়ছে। যুদ্ধ চলছে, চলবে। তাকে থামতে দিলেই বিপদ। থামিয়ে দিলে আমরা বাঁচব না। লুণ্ঠন ও হতাশা আমাদের থামিয়ে দেবে। অতীতের সব আন্দোলনেরই প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা। স্বতঃস্ফূর্ততা একটা বড় গুণ। তাতে প্রাণ থাকে কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ততার একটা সীমাও আছে। যে আন্দোলন কেবলই স্বতঃস্ফূর্ত সে অগোছালো, তার পক্ষে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন এবং সর্বোপরি সে স্বল্পে সন্তুষ্ট। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততা অবশ্যই প্রয়োজন, মানুষ প্রাণের তাগিদে আসবে, এসে ধারা প্রবাহকে প্রাণবন্ত ও বেগবান রাখবে। সে জন্য সুসংগঠিত হওয়া জরুরি। তার জন্য সংগঠন দরকার, তেমন সংগঠন যা ক্রমাগত শক্তিশালী হবে, আমলাতান্ত্রিকতার দ্বারা অভিভূত হবে না। অতীতের আন্দোলন আমাদের শিখিয়েছে, থেমে যেতে নেই, থেমে গেলেই বিপদ। সে বিপদ থেকে পরিত্রাণের জন্য চাই ক্রমাগত সুসংগঠিত আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। কাজটা কঠিন। এ কাজ প্রধানত রাজনৈতিক, কিন্তু সে সঙ্গে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকও। এর জন্য নতুন সংগঠনের সঙ্গে প্রয়োজন নতুন নেতৃত্বের। কিন্তু সংস্কৃতিকে প্রায়ই রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে যেতে হয়। অতীতে যেতে হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। এখনো সেটাই প্রয়োজন। রাষ্ট্র যে পথে চলছে সে পথটা আলোর নয়, দেয়ালের! দেয়ালের পর দেয়াল উঠবে। মানুষ বিচ্ছিন্ন হবে, উদার হওয়ার নাম করে সংকীর্ণ হয়ে পড়বে। বন্দী হবে প্রাচীরে।

এই বিপন্ন যাত্রার মারাত্মক পরিণতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিপরীত আদর্শের প্রয়োজন। এই আদর্শই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বের হয়ে এসেছিল। ওই প্রথম আমরা এক হয়ে ঘোষণা করতে পেরেছিলাম যে, আদর্শ হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধ নির্দেশিত ওই আদর্শের প্রতিষ্ঠা ছাড়া দেয়াল তোলা থামবে না, থাকবে না নিজস্বতা হারিয়ে ফেলা এবং উন্নতি  করা। অন্যরা তো বটেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষও স্পষ্ট জানেন না যে, ওই চেতনাটি কী? চেতনাটি ধ্যান নয়, দলীয় আনুগত্য নয়, চেতনা হচ্ছে একটি আদর্শ বাস্তবায়নের আগ্রহ। যে আগ্রহই পারে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি নিয়ে আসতে। যার অভাবই আমাদের জাতীয় জীবনে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই তো মুক্তির সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি, হবেও না। যতদিন না আমরা নতুন সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। প্রভু-ভৃত্যের নয়। সহযোদ্ধার বন্ধুর।

 

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর