শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ

একটানা গড়ে ১৮ ঘণ্টা কাজ করে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর জোগাড় করেও ১৬ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকতে পারিনি। সেটা আমার জীবনের একটা বড় আক্ষেপ। সেদিন ভোর ৭টার মধ্যে পূর্বাঞ্চলের হেড কোয়ার্টার কোর্ট উইলিয়ামে আমাকে এবং যুগান্তর  কাগজের প্রাক্তন চিফ রিপোর্টার অনিল ভট্টাচার্যকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে পাকিস্তান পতনের রিপোর্ট করার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সামরিক বিভাগের গাফিলতি এবং সাহেব রিপোর্টারদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের জন্য। আমাদের নেওয়া হলো না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাদের বলা হচ্ছিল, এখনই তোমাদের হেলিকপ্টারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে।

বেলা গড়িয়ে গেলে আমরা উত্তেজিতভাবে ফোর্ট উইলিয়ামের অফিসারদের প্রশ্ন করলাম, আমাদের যাওয়ার কী হলো? উত্তর পেলাম। ডিসেম্বরের সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আর হেলিকপ্টার আকাশে উড়বে না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। নমাস ধরে কী করলাম? খারাপ মন নিয়েই অফিসে চলে এলাম। সোজা সম্পাদকের ঘরে। অশোক বাবু (অশোক সরকার) আমাকে দেখে প্রশ্ন করলেন, কেমন দেখলেন? কেমন হলো? আমি তাকে বললাম, স্যার আমার যাওয়া হয়নি। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, কেন? তখন উপরের ঘটনাটা তাকে বললাম। তিনি টেলিফোন অপারেটরকে বললেন, দিল্লিতে জগজীবন বাবুকে ধরে দাও। জগজীবন রাম তখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। অশোক বাবুর সঙ্গে তার বেশ হৃদ্যতা ছিল।

অশোক বাবু জগজীবনকে বললেন, আপনি হয়তো জানেন না, আমার এই রিপোর্টার নমাস কঠোর পরিশ্রম করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সব খুঁটিনাটি সে রিপোর্ট করেছে। আপনিও তো তাকে চেনেন। বাবু জগজীবন রাম অশোক বাবুর প্রশ্নের কী জবাব দিয়েছিলেন। তা আমি শুনতে পাইনি। টেলিফোন রেখে অশোক বাবু বললেন, ১৮ তারিখ সকালে সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার  আপনাকে নিয়ে ঢাকায় যাবে। আপনি চলে আসবেন না। ওখানে থাকবেন। সেটাই ছিল তার নির্দেশ।

সেই যে ঢাকায় গেলাম একটানা প্রায় চার বছরের অধিক সময় বাংলাদেশের যাবতীয় ঘটনার সাক্ষী হিসেবে রিপোর্ট করেছি। রিপোর্ট করেছি বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র নিয়েও। রিপোর্ট করেছি ইন্দিরা গান্ধী ও বিশ্বের তাবৎ নেতার বাংলাদশ সফর। কিন্তু আমার একটাই আফসোস থেকে গেল, ১৬ ডিসেম্বর আমি ঢাকায় থাকতে পারিনি। ঢাকায় যেতে পারিনি বলে মন খারাপ করে অফিসে বসে থাকিনি। সেদিন কলকাতায় কী ঘটেছিল, তারও সাক্ষী ছিলাম।

৪৫ বছর আগে ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে যে নতুন রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল, তার নাম বাংলাদেশ। বাঙালির দেশ। ৯ মাস লেগেছে মুক্তিবাহিনী, মুজিববাহিনী এবং যৌথ বাহিনীর এই স্বাধীনতা অর্জন করতে। ১৬ ডিসেম্বর শীতের সন্ধ্যায় আগেই খবর এসে গেল পাকিস্তান ফৌজ যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ শুরু হওয়ার অনেক আগেই ভারতীয় ফৌজের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মানেকশ একটি বিবৃতি প্রচার করেন-পাকিস্তান সেনারা কে কোথায় আছেন, আমরা জানি। আপনারা আত্মসমর্পণ করুন। পাল্টা পাকিস্তান থেকে বলা হয়, আত্মসমর্পণ করা হবে না।

৩ নভেম্বর যুদ্ধের এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ এলাকা  যৌথ বাহিনীর দখলে এসে যায়। জেনারেল নিয়াজি ও ইয়াহিয়া খানের জেদ, আত্মসমর্পণ নয়। যুদ্ধবিরতি। ভারত সরাসরি নিয়াজির সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিন জেনারেল— জেনারেল জ্যাকব, জেনারেল সৌগত সিংহ এবং জেনারেল বিএন সরকার হেলিকপ্টার নিয়ে ঢাকায় উড়ে যান। ক্যান্টনমেন্টে বৈঠক। নিয়াজিকে তারা বলেন, ঢাকার সিভিল এরিয়ার কিছু জায়গা ছাড়া সবটাই আমাদের দখলে।

জেনারেল জ্যাকব : নিয়াজি সাহেব, আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, আপনার পরিবার আপনার ফৌজ সম্পূর্ণ নিরাপত্তা পাবেন।

নিয়াজি : নো, নো, নো। আত্মসমর্পণ নয়। যুদ্ধবিরতি। পাশে অন্য দুই জেনারেল বললেন, নিয়াজি সাহেব আমাদের পক্ষে আর দেরি করা সম্ভব নয়। আপনাকে দশ মিনিট সময় দিচ্ছি। আপনি আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে আমাদের চিঠি দিন। নিয়াজি তখন এঘর ওঘর করে ছটফট করতে থাকেন।

জেনারেল জ্যাকব : আপনাকে যে সময় দেওয়া হলো, তাতে আপনি আপনার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে নিতে পারেন। কিন্তু আমাদের হাতে আর সময় নেই। আমাদের ফিরতে হবে। আপনাকে আরেকবার অনুরোধ করছি, যত দেরি করবেন, ততই আপনাদের লোকসান হবে। ফিরে এসে ওই তিন সাংবাদিককে বলেছিলেন : নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি। সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে ঘোষণা করা হয়— ৯৪ হাজার ফৌজ নিয়ে নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছেন। ঢাকা ছাড়ার আগে জেনারেল জ্যাকব নিয়াজিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে আসেন, ঢাকাসহ বাংলাদেশের কোথাও নাগরিকের ওপর অত্যাচার করবেন না। ১৬ তারিখ এলো। কলকাতা থেকে উড়ে গেলেন পূর্বাঞ্চলে সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিত সিংহ অরোরা। সঙ্গে ওই তিন জেনারেল। ঢাকার রমনা ময়দানে প্রকাশ্যে লাখো মানুষের সামনে নিয়াজির সামরিক ব্যাজ খুলে নেওয়া হয়। এদিকে কলকাতায় সারা রাজ্যে যেখানে উদ্বাস্তুরা আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানে জয়ধ্বনি, উলুধ্বনি পটকা ফাটানো শুরু হয়ে যায়। গোটা কলকাতা মেতে ওঠে উৎসবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে—

‘শোন একটি মুজিবরের থেকে

লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের

 ধ্বনি, প্রতিধ্বনি

আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।

বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ...’

গানটি প্রচারিত হতে থাকে।

অবশ্য নমাস মুক্তিযুদ্ধ কভার করলেও, সেই শুভক্ষণে আমি ঢাকায় উপস্থিত ছিলাম না। ঢাকার সইয়ের পর ভারতের পার্লামেন্টে (লোকসভায়) ৫৪৫ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর আসতে একটু দেরি হয়। কারণ তিনি তার ঘরে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। ইন্দিরা সংসদে এই সংবাদ ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধজয়ের আনন্দে কলকাতা সেদিন তিলোত্তমা হয়ে উঠেছিল। গোটা শহর ছুটেছিল থিয়েটার রোডের অস্থায়ী মন্ত্রিসভার অফিসের দিকে। ভিড় ঠেলে আমরা এগোতে পারছিলাম না। কোনোভাবে দোতলায় উঠে তাজউদ্দীন সাহেবের ঘরের দিকে যেতেই বিএসএফের শীর্ষকর্তা বললেন, আপনারা এখন ভিতরে ঢুকবেন না। ইন্দিরা গান্ধী এসেছে। ইন্দিরার সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার পর দরজা খুলে দেওয়া হলো। ততক্ষণে সেখানে প্রায় ১৫০ সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষ জড়ো হয়েছেন। ৪৫ বছর পরেও সেই স্মৃতি আমার এখনো চোখের সামনে ভাসছে। চার নেতাই এক সুরে বলে উঠলেন, এখন আমাদের কাজ পাকিস্তান জেল থেকে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধার করা। তাজউদ্দীন সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বললেন, ভারতের সংসদে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে বিবৃতি দিয়েছেন, আমাদের এখন লক্ষ্য শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতেই হবে বলে কামারুজ্জামান, নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীরা বললেন, কলকাতার সংবাদ মাধ্যমকে ধন্যবাদ। নমাস ধরে আপনারা যে সাহায্য করলেন তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। বাঙালিরা তাদের সম্মান ফিরে পেয়েছে। বাঙালিরা পাকিস্তান বাহিনীকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে দিয়েছে।

সেদিন কলকাতা শহরে মনে হচ্ছিল, সব লোক বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে এই আনন্দের অংশীদার হতে। আমি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ানের কাছে শুনেছি, ১৬ ডিসেম্বর রাত তখন দুটো। ওয়ার রুমে খবর এলো, পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনী লাহোর শহর দখল করতে আর মাত্র ৪০ মিনিট লড়াই করতে হবে। খবর পেতেই উদ্বিগ্ন ইন্দিরা গান্ধী বললেন বাবুজি (প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাবু জগজীবন রাম) এবং বাকি সবাইকে খবর দাও। তাড়াতাড়ি আসার জন্য। ইন্দিরা গান্ধী প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বললেন, আপনি শ্যামকে (শ্যাম মানেকশ) ফোন করুন। বলুন, ভারতীয় বাহিনী যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানেই থাকুক। লাহোর দখল করতে হবে না। কারণ লাহোরে এক কোটির বেশি লোক। তাদের দায়িত্ব নিতে হবে।

তাই করা হলো। ইন্দিরা একতরফাভাবে পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে দিলেন। ইন্দিরা ব্যাখ্যাও করেছিলেন ’৬২-তে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ, ’৬৫-ত পাকিস্তানের সঙ্গে আর এই যুদ্ধে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়ে গেছে। আমাদের ভাঁড়ারে আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। লাহোরের এক কোটি লোককে খাওয়ানো সম্ভব নয়। তার ওপর ৯৪ হাজার পূর্ব পাকিস্তান থেকে আনা সৈন্যদের কতদিন রাখতে হবে জানি না।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সেপ্টেম্বর মাস থেকে ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের ২১টি দেশ ঘুরে, সেখানকার রাষ্ট্রপ্রধানদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, পাকিস্তানের এই আচরণ অমানবিক। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান, পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইন্দিরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের সব জেলায় তিনি উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে কথা বলেছিলেন। যুদ্ধ শেষে তাজউদ্দীনকে একটি চিঠি লিখে ইন্দিরা বলেছিলেন, আপনার চার সহকর্মী যেভাবে লড়াই করেছেন, তা ইতিহাসে এক নতুন নজির সৃষ্টি করল। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।

আর সাংবাদিক হিসেবে দেখা একটি নতুন দেশের জন্ম এখনো চোখের সামনে ভাসছে। পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের ফলে বঙ্গবন্ধু তার পরিবার ও চার স্বাধীনতা যুদ্ধের মন্ত্রীদের আত্মত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রম এখন সাফল্যের দিকে এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে।

 

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর