সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিজয়ের শক্তি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বিজয়ের শক্তি

ডিসেম্বর মাস মানেই বিজয়ের মাস, দেখতে দেখতে চলে গেল সুবর্ণজয়ন্তী, শুধু বাংলাদেশের নয়, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশগুলোর কাছে এই ডিসেম্বর মাসটি হয় বিজয়ের মাস। ২৪ বছর আগে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা পাকিস্তান স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত্ব ভেঙে চুরমার করে দিয়ে পদ্মা-মেঘনার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তান নামে যে দেশটির সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, ২৪ বছর ধরে সংগ্রাম করে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে উপহার দিলেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র যে মানুষটি, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাঁর অনুপস্থিতিতে মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরই সুযোগ্য চার নেতা, এরা হলেন- তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আর আবু হেনা কামারুজ্জামান। সরকারিভাবে ১৩ দিনের যুদ্ধ আর আসল যুদ্ধ নয় মাসের। এই নয় মাস মুক্তিকামী পাগল মানুষগুলো শুধু রক্তই দেয়নি, এই ১৬ ডিসেম্বরের জন্য তারা সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিল।

সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস থেকেই আমরা সমর সংবাদদাতা। বাংলাদেশের জেলায় জেলায় ঢুকে গিয়ে আমরা দেখেছি সেই বীর সৈনিকদের সামরিক পোশাক পরে গেলেও যুদ্ধের খবর সংগ্রহের জন্য আমাদের হাতে ছিল না পিস্তল, বন্দুক, স্টেনগান। আর আমাদের সামরিক পোশাকের বুক পকেটে ছিল একটি ধারালো অস্ত্র, অর্থাৎ একটি পেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতে এক কোটির বেশি লোক চলে এসেছিল। এটাও একটা ইতিহাস আর এপারে এসে ওই নেতারা ইয়াহিয়া-ভুট্টোর বাঙালিবিরোধী অপপ্রচারের জবাব দেওয়ার জন্য ১৭ এপ্রিল সরকার শপথ নেওয়ার চার দিন আগেই কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার প্রথম ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, বীর বাঙালিদের কর্মকা- দেখার জন্য বিশ্বের সাংবাদিক, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক পর্যটকদের অনুরোধ করছি, আপনারা একবার মুক্তাঞ্চল দেখে আসুন, আপনাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরাই করব।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তাজউদ্দীনের প্রথম ভাষণটি বারবার প্রচার করা হয়েছে ভারতের বেতার কেন্দ্র আকাশবাণী থেকে। তাজউদ্দীন সেদিন তার ভাষণে যা বলেছিলেন তা হলো- সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল মানুষের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা স্মরণ করছি তাদের, যারা বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামে জীবন আহুতি দিয়েছেন। আকাশে যতদিন চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-তারা থাকবে, মাটিতে মানুষ থাকবে, ততদিন বীর শহীদের এই সমর কৃতিত্ব অমøান থাকবে বাঙালির মানসপটে। ২৫ মার্চ থেকে ইয়াহিয়া তার ফৌজ লেলিয়ে দিয়েছে আমাদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পতাকাতলে আমরা আজ একাত্ম। যে প্রতিরোধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এই অভূতপূর্ব সংগ্রাম ও অসাধারণ মনোবল যা নিয়ে আপনারা ইয়াহিয়ার ফৌজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। প্রমাণ হলো এক নতুন বাঙালি জাতি জন্ম নিচ্ছে।

বিশ্বে আমাদের পরিচয়-শান্তিপ্রিয়, মানবতাবাদী, নৃত্যগীত, শিল্প-সংস্কৃতির পূজারিরূপে, হিংসা আমাদের চরিত্রবিরোধী কিন্তু আজ যখন প্রবল মারণাস্ত্র দিয়ে আমাদের ওপর শত্রু ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তখন আমরা সেই মহান ঐতিহ্যে অবিচল থেকেও প্রমাণ করে দিয়েছি, বাঙালি দরকার হলে শত্রুর বিরুদ্ধে শক্ত হাতে অস্ত্র ধারণ করতে জানে। শত্রু যখন মরণ কামড় দিতে আসে, সঙ্গে সঙ্গে আপনারা যদি জীবনপণ করে রুখে না দাঁড়ান, তাহলে এই নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কোথায় তলিয়ে যেত এই দুনিয়ায়। জানি না আবার কত যুগ যেত জেগে উঠতে। কিন্তু আপনারা জীবন দিয়ে সেই সর্বনাশ প্রতিরোধ করেছেন। ওদের আক্রমণ কামানে-বিমানে। আপনাদের প্রতিরোধ শূন্যহাতে; কিন্তু অনির্বাণ দেশপ্রেমে। শত্রু আজ পিছু হটেছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকা আজ মুক্ত। দুনিয়ার সাংবাদিকরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশে স্বচ্ছন্দে ঘুরছে, বিস্মিত হচ্ছে সব দেখে, চারদিকে পাঠাচ্ছে বিজয় বার্তা। গোটা পৃথিবী এখন উপলব্ধি করতে শুরু করেছে আমাদের সংগ্রামের তাৎপর্য। বাংলাদেশের সর্বত্র এখন প্রতিরোধ বাহিনী শক্ত পায়ে দাঁড়িয়েছে। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী এসে শামিল হচ্ছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে।

আজ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের অভিজ্ঞ সৈনিকরা এসে যোগ দিয়েছেন আমাদের সঙ্গে। এতে আরও জোরদার হয়েছে মুক্তিফৌজ। এই জোর বিপুল, প্রবল হয়ে উঠছে পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ এবং হাজার হাজার আওয়ামী লীগ কর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়ায়। ভাড়াটে পাক সৈন্যদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া অস্ত্র দিয়েই পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে আমাদের মুক্তিবাহিনীর এসব তরুণ-তরুণী। পৃথিবীর নানা দেশে আমাদের যে বাঙালি ভাইবোন রয়েছে, তারাও আমাদের জন্য তহবিল খুলে অর্থ সংগ্রহ করে তা দিয়ে আধুনিক সব অস্ত্র কিনে পাঠাচ্ছে। আজ আর আমরা নিরস্ত্র নই। তাজউদ্দীন তাঁর ভাষণে আরও বলেছিলেন, বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে যারা পাকিস্তানকে অস্ত্র জোগাচ্ছে, তাদের উদ্দেশে বলছি-পাক জল্লাদ বাহিনীর হাতে আর অস্ত্র দেবেন না। বহিরাক্রমণ ঠেকানোর নাম করে আনা ওই অস্ত্র বাংলাদেশের নিরপরাধ নারী-শিশু হত্যার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিশ্ব সমাজ বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছে বৃহত্তম দেশগুলোর মধ্যে অষ্টম স্থান অধিকার করতে যাচ্ছে নতুন এক রাষ্ট্র, স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারত ইতিমধ্যেই পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। রাশিয়া এই নিপীড়ন বন্ধ করতে বলেছে পাকিস্তানকে। ব্রিটেনও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। সিংহল ও ব্রহ্মদেশ তাদের দেশ থেকে পাকিস্তানি বিমানকে তেল দিতে অস্বীকার করেছে। বর্বর পাক-ফৌজের দখলীকৃত আমাদের যে অবরুদ্ধ ভাইবোনরা দিবারাত্রি মৃত্যু বিভীষিকার মধ্যে রয়েছেন, তাদের উদ্দেশে বলছি, মনোবল হারাবেন না। মুক্তি-ফৌজের শক্তির ওপর আস্থা রাখুন। জয় আমাদের অতি সন্নিকটে। ইনশাআল্লাহ।

তবে এই জয়ের পর পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসস্তূপের ওপর যে বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব, তা হবে সর্বঅর্থে আদর্শ। মনে রাখতে হবে, জনগণের দ্বারা পরিচালিত এই যুদ্ধ যথার্থ জনযুদ্ধ। এই দেশ হবে মেহনতি মানুষের এক শোষণমুক্ত ভূমি। আমাদের মুক্তির মধ্যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, ক্ষুধা, ব্যাধি, অশিক্ষা ও বেকার থেকে মুক্তির। এখানে প্রতিষ্ঠিত হবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আধুনিক, গণতান্ত্রিক সমাজ, যার ভিত্তি সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার। জয় বাংলা। তাজউদ্দীনের ওই বজ্রদীপ্ত ভাষণের পর গোটা বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী আরও প্রাণোজ্জীবিত হয়ে ওঠে। খুব কষ্টের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ৫০ বছর পর বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম এমনকি যাদের ৫০-৬০ বছর বয়স তারাও তাজউদ্দীনের নাম ও তার কর্মকান্ড সম্পর্কে কোনো ধ্যান-ধারণা নেই। কিন্তু আবার ফিরে এসেছে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। বেতারে ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কলকাতা শহরে বিজয় মিছিল বেরিয়েছিল। চারদিকে পটকা ফাটছিল আর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার রেকর্ড বাজানো হচ্ছিল। ভারতীয় সময় বিকাল সাড়ে ৫টা নাগাদ দিল্লিতে লোকসভায় দ্রুতবেগে ইন্দিরা গান্ধী প্রবেশ করতেই ৫৪৫ জন সদস্য ওঠে দাঁড়িয়ে হর্ষধ্বনি করে ইন্দিরা গান্ধীকে অভিনন্দন জানাতে থাকেন। আর কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসের সামনে হাজার হাজার মুক্তিবাহিনী ও এ দেশের জনগণ জমায়েত হয়েছিলেন। তাদের মাইকের সাহায্যে বলা হলো, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জনগণ বিপুল জয়ধ্বনি করে উঠল। জয় বাংলা, জয় মুজিব, জয় ইন্দিরা গান্ধী, জয় যৌথবাহিনী। সংসদে বিরোধী দল নেতা, জনসংঘের অটল বিহারি বাজপেয়ি মন্তব্য করলেন, ‘আপনি দেবী দুর্গা’ আর আরএসপি নেতা ত্রিদীপ চৌধুরী এতই আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে, তার মন্তব্যটি ছিল এইরূপ-‘সংসদে ৫৪৪ জন সদস্যই হলো মেয়ে, আপনিই একমাত্র পুরুষ। আপনি যা পারলেন তা বিশ্ববাসী চিরদিন মনে রাখবে।’

 

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর