শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

মা এবং ভাষা এক ও অভিন্ন

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মা এবং ভাষা এক ও অভিন্ন

অলঙ্করণ : শাকীর

বাংলা ভাষার জননী হলো সংস্কৃত। মূল সংস্কৃত থেকে পালি, প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা তার আজকের রূপ লাভ করেছে। যে কোনো ভাষাই হলো নদীর স্রোতের মতো, সে নিজের ধারায় বয়ে যায়। কিন্তু তথাকথিত মানব সভ্যতার আগ্রাসী লোভ বাংলা ভাষাকে বেঁধে দিল রাজনৈতিক সীমারেখার শৃঙ্খলে। আজ ভাষা দিবস নিয়ে লিখতে বসে বলতে ইচ্ছা করছে মা এবং ভাষা এক ও অবিচ্ছিন্ন, কিন্তু আজকের বাংলাদেশ যখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পৃথিবীর মানচিত্রে পরিচিত ছিল তখন এই দেশটি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্গত ছিল। তাই বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করার কোনো অধিকার ছিল না পূর্ব পাকিস্তানের। তাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল উর্দু ভাষা। যদিও বাংলা ভাষাভাষীর জনগণ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এক ছাত্রসভায় ঘোষণা করলেন উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। তখন ছাত্ররা বিদ্রোহ করে জিন্নাহর মুখের ওপর বলে দেয় বাঙালিরা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই বাংলাই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তাদের দাবি জিন্নাহ মানতে চাননি, তাই তিনি পুলিশ ডাকেন ও ছাত্রদের ওপর পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের জাতির পিতা ও তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, তারপর থেকেই বাংলা ভাষার দাবিতে পূর্ব বাংলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাকে জাতীয় ভাষা করার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনের কথা আজ ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন আন্দোলন করছিলেন পাকিস্তান পুলিশ তাদের মধ্যে পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করে। এই পাঁচজন হলো- সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও সফিউর (যতদূর মনে পড়ে নামগুলো দিলাম) আমার মনে আছে এপার বাংলায় তখন আনন্দবাজার, দেশ পত্রিকার কর্ণধাররা প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন। ঠিক এই কথায় জওহর লাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ প্রকাশিত হয়, সেই চিঠিতে নেহরু লিখেছিলেন- আমার অনুরোধ আপনারা এই বইটি গুরুদেবের ভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করুন। ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ অনুবাদ করেন তৎকালীন আনন্দবাজার সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার। নেহরু তাঁর চিঠিতে আরও লিখেছিলেন যে, বাঙালিরা তাঁর এই বইটির মূল বিষয় পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন, এখনো এই বইটির সর্বত্র চাহিদা আছে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়ের মতো গুণী-জ্ঞানী ব্যক্তিরা বাংলা ভাষার বিকাশে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের লেখা ‘বর্ণ পরিচয়’ বইটি মানব সভ্যতার মশালে আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। বর্তমানে পৃথিবীর জনগণের মধ্যে বাংলা ভাষাভাষীর লোকসংখ্যা সম্ভবত ৩৫ কোটি। একমাত্র বাংলাদেশের বিমান ‘বাংলাদেশ’ শব্দটাকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিমানের সঙ্গে আকাশে উড়ার সাহস দেখাতে পেরেছে। জাতিপুঞ্জও বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে অনেক আগেই।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে তার ভাষণ বাংলায় দিয়েছিলেন। সেই থেকে তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা প্রতি বছর জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। এটাও বাঙালিদের কাছে গর্বের বিষয়।

১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহীদদের উদ্দেশে প্রতি বছর ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা থেকে জনস্রোত উপচে পড়ে ঢাকা শহরে শহীদ স্তম্ভের দিকে। ওপার বাংলায় বসে আমরা সব শুনতাম ও কাগজে পড়তাম।

১৯৭২ সালে আমার মনে আছে, এম আর আখতার মুকুল আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখি ঢাকার রাস্তায় যেন আর এক স্বাধীনতার উৎসব। আমি তো অভিভূত। এ কী দেখছি, এ সময় হাজার হাজার কবিতার বই প্রকাশিত হয়। তা বিনামূল্যে ঢাকার রাস্তায় বিতরণ করা হয়। সেই ১৯৫২ সাল থেকে মাতৃভাষা বাংলার প্রতি বাঙালিদের এক অবিচ্ছিন্ন নাড়ির টান লক্ষ্য করা যায়। কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়-

‘স্বাধীনতা তুমি

শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা

 

স্বাধীনতা তুমি

অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।’

 

বাংলা ভাষাকে নিয়ে একটি ঘটনা আমার সামনেই ঘটেছিল। বিষয়টি ছিল বাংলা ভাষা বড় না হিন্দি ভাষা বড়। ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ৭-৮ দিন পর দিল্লিতে গঙ্গারাম হসপিটাল মার্কেটে আনন্দবাজারের গেস্ট হাউসে মোরারজি দেশাইয়ের মন্ত্রিসভার সব সদস্যকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন আনন্দবাজারের সম্পাদক অশোক কুমার সরকার। জনসংঘের নেতা মোরারজির তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানিকে (বিজেপির স্রষ্টা) অশোক বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা হিন্দি হিন্দি নিয়ে চিৎকার করছেন কেন? হিন্দি কোনো ভাষাই নয়’। অশোক বাবুর কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন আদভানি। পরিস্থিতি দেখে আনন্দবাজারের ম্যানেজিং এডিটর অশোক বাবুর পুত্র অভীক বাবু আমাকে ডেকে বললেন, ‘এখনই বাবাকে থামান। উনি আমাদের অতিথি। দেখলাম উনি না খেয়েই চলে যাচ্ছিলেন। তখন আমি গিয়ে বললাম- খাবার ঠান্ডা হয়ে হয়ে যাচ্ছে।’ এরপর অশোক বাবু আদভানির হাত ধরে খেতে বসালেন। খাবার টেবিলেও অল্পবিস্তর হলেও তর্ক চলছিল।

আরও একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি, প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমেরিকার সরকার দুই মাসের জন্য আমেরিকা সফরে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যায়। ১৫ দিন পর হঠাৎ শ্যামল বাবু ফিরে এলেন। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি তো দুই মাসের জন্য গিয়েছিলেন। তিনি বললেন দেখ আমি ২৪ ঘণ্টা ইংরেজি বলতে পারব না, তাই ফিরে এসেছি। আমার নিজের অভিজ্ঞতাও কম নয়। পেশাগত কারণে পৃথিবীর ৩৫-৩৬টি দেশ ভ্রমণ করেছি। সব সময় ইংরেজি বলতে বিরক্ত লাগে। অথচ যখন আমি বাংলাদেশে যাই তখন অভিবাসন দফতর থেকে ট্যাক্সিওয়ালা সবাই বাংলায় কথা বলে। তখন মনে হয় ‘আমি এক শুদ্ধ ভাষায় কান পেতেছি।’ যা আমারও মাতৃভাষা। আমি জানি না-আমার মনে নেইÑ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গে একটি গান খুব প্রচলিত ছিলÑ ‘রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের তার নাইকো শেষ।’

যতদিন পৃথিবীর বুকে মানব সভ্যতা থাকবে ততদিন ২১ ফেব্রুয়ারি তার উজ্জ্বলতা বজায় রাখবে। শুধু বাংলাদেশে নয়, এপার বাংলায় এই দিন চির অক্ষয় হয়ে থাকবে। এই ভাষা দিবসের শহীদদের উদ্দেশে আমার বন্ধু গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছিলেন-

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী

আমি কি তা ভুলিতে পারি।’

এই গানটি স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও উজ্জীবিত করেছিল। শেষ করছি এপার বাংলার কবির ভাষায়-

‘তোমার শীতলক্ষ্যা আর আমার ময়ূরাক্ষী

তোমার ভৈরব আর আমার রূপনারায়ণ

তোমার কর্ণফুলী আর আমার শিলাবতী

তোমার পায়রা আর আমার পিয়াঙ্গী

একজল এক ঢেউ এক ধারা

একই শীতল অতল অবগাহন, শুভ দায়িনী শান্তি।’

 

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর