রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রভাষা এবং রাষ্ট্রের ভাষা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

রাষ্ট্রভাষা এবং রাষ্ট্রের ভাষা
তহশিল অফিসের কাগজপত্র তুলনায় সরল বাংলায় লেখা হলেও কৃষকের জন্য সে ভাষা বিষময়, যে জন্য দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে কোনো অভ্যুত্থান ঘটলে লোকে তহশিল অফিস পুড়িয়ে দিতে আগ্রহী হয়, উনিশ শ ঊনসত্তরের  অভ্যুত্থানের সময় যেমনটি দেখা গেছে। উচ্চতর আদালতের ভাষা এখনো ইংরেজিই রয়ে গেছে...

রাষ্ট্রের ভাষা এবং রাষ্ট্রভাষা যে সব সময়ে কিংবা হুবহু এক হবে এমন কোনো কথা নেই। এটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বেশ বোঝা যায়, এ-রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, সংবিধান তা-ই বলছে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা ও বোঝা যায় যে, রাষ্ট্রের ভাষা ঠিক বাংলা নয়, অন্য কিছু। এটি অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, এমনটা প্রায়ই ঘটে, দেখা যায় রাষ্ট্রের একটা নিজস্ব ভাষা রয়ে গেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্র যদি হয় কর্তৃত্বপরায়ণ এবং বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থসংরক্ষণকারী।

আমাদের রাষ্ট্রের কর্মকর্তা যাঁরা তাঁরা যে বাংলা চর্চা করেন, কিংবা তাঁরা যে বাংলার পক্ষের লোক তা নয়। উচ্চপদে আসীন অসামরিক আমলারা ইংরেজিই পছন্দ করেন, কথাবার্তায় তো বটেই, এমনকি দাফতরিক কাজেও। সামরিক আমলাতন্ত্র ইংরেজি ব্যবহারেই অভ্যস্ত। আমাদের এই স্বাধীন রাষ্ট্রকে বিশ্ব পুঁজিবাদের যে-রাষ্ট্রভাষা, অর্থাৎ ইংরেজি, সে-ভাষাটাকেই ব্যবহার করতে হয়। পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী লজ্জায় পড়েন, ইংরেজিতে চৌকস না হলে। বড় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা অচল ইংরেজির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপনে অসমর্থ হলে। বাংলাদেশের এখন লগ্নি পুঁজির অপ্রতিহত দৌরাত্ম্য, এই পুঁজি বাঙালিকে অবশ্যই ব্যবহার করবে, কিন্তু বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করবে না, পারতপক্ষে। আমাদের রাষ্ট্র জনগণের নিজের হস্তক্ষেপে গড়া, কিন্তু এ রাষ্ট্র জনগণের নয়, এর কাজ ধনীদের স্বার্থকে পুষ্ট ও রক্ষা করা। বাংলাদেশের ধনীদের জীবনে বাংলা ভাষার ব্যবহার কীভাবে সংকুচিত হচ্ছে এবং ঈশ্বর সহায় হলে আরও যে হতে থাকবে তার জন্য কোনো জরিপ বা গবেষণার আবশ্যকতা নেই, রাজধানীতে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর সামনে রোজ সকালে গাড়ির উপচেপড়া ভিড় দেখলেই টের পাওয়া যাবে, হাড়ে হাড়ে।

আসল কথা এই যে, রাষ্ট্রের নিজস্ব যে ভাষা সেটা যে বাংলা হবে এমন সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, অত্যন্ত আশাবাদী মানুষও আশার এই আলোকবর্তিকাকে উজ্জ্বল করে তোলা যাবে বলে ভরসা করছেন না। এমনকি রাষ্ট্রের ওই ভাষা যদি বাংলাও হতো তাহলেও তা বাংলা হতো না, কেননা ভাষা তো কেবল শব্দ নয় বা বাক্য নয়, তার একটা স্বরও আছে বৈকি। ভাষাকে সম্পূর্ণতা অর্থনির্ভর বলা যাবে না, সে স্বরনির্ভরও বটে। যে রাষ্ট্র হুঙ্কার, ধমক, হুকুম ইত্যাদি দেয়, আশ্রয় না দিয়ে ভয় দেখায়, দরিদ্রকে আরও দরিদ্র করে, তার ভাষা বাংলা হলেও বাংলা হবে না; রাক্ষস ভূত-প্রেত কিংবা অন্যান্য বৈরী প্রাচীন মাতৃভাষার পক্ষে মানুষের ভাষা হওয়া সম্ভব নয় এবং তা সে হয় না, হতে চায়ও না। নিম্ন আদালত ও কোর্ট-কাচারিতে অনেক কাল ধরেই বাংলা ভাষা চালু আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য সে ভাষা ইংরেজি কিংবা তারও আগের ফার্সির তুলনায় কম দুর্বোধ্য নয়। তহশিল অফিসের কাগজপত্র তুলনায় সরল বাংলায় লেখা হলেও কৃষকের জন্য সে-ভাষা বিষময়, যে জন্য দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে কোনো অভ্যুত্থান ঘটলে লোকে তহশিল অফিস পুড়িয়ে দিতে আগ্রহী হয়, উনিশ শ ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময় যেমনটি দেখা গেছে। উচ্চতর আদালতের ভাষা এখনো ইংরেজিই রয়ে গেছে, তাছাড়া ফাঁসির হুকুম ইংরেজিতে না এসে বাংলায় এলে ফাঁসির কোনো কোনো ইতরবিশেষ ঘটবে না, এমনকি ফাঁসির দড়ির রংটা যে বদলাবে তাও নয়।

অথচ এই নতুন রাষ্ট্র যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা তো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই। প্রথমে দাবি ছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষার, অর্থাৎ দুটি রাষ্ট্রভাষা থাকবে পাকিস্তানের, যাদের একটি হবে বাংলা। কিন্তু ওই আন্দোলনের মধ্যে পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলার যে আকাক্সক্ষাটা ছিল তা ক্রমাগত তীব্র হয়েছে এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে। এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে এটা ছিল স্বতঃসিদ্ধ; সাংবিধানিকভাবে সেটাই হয়েছে। কিন্তু হায়, রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা হয়নি।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কি উর্দুবিরোধী ছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু ছিল কি সে ইংরেজিবিরোধী? হ্যাঁ, সেটাও হওয়ার কথা ছিল বৈকি। কেননা, আন্দোলন ছিল বাঙালি নিজের পায়ে দাঁড়াবে, বাংলা ভাষার মধ্য দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, ইহজাগতিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, যেখানে মানুষের পরিচয় ধর্ম, সম্প্রদায় কিংবা অর্থনৈতিক শ্রেণির দ্বারা চিহ্নিত হবে না, পরিচয় হবে ভাষার দ্বারা।

কিন্তু রাষ্ট্র গণতন্ত্রের পথে যায়নি। বাংলাদেশে অন্তত একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এই আশাটা ছিল। বৃষ্টিহীন দুপুরের রঙধনুর মতোই সে আশা মিলিয়ে গেছে। আশার স্মৃতিটা এখন পীড়া দেয় তাদের যাদের হৃদয় আছে। বাংলাদেশে সাবেক পাকিস্তানের মতোই একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। গণতন্ত্রের মূল কথা যে অধিকার ও সুযোগের সাম্য, জনগণের ন্যূনতম নাগরিক অধিকারগুলোর কার্যকর স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে সর্বস্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা, তার কোনো কিছুই আজ বাংলাদেশে নেই।

বাংলাদেশের ইতিহাস নিরবচ্ছিন্ন স্বৈরশাসনের ইতিহাস। এই স্বৈরশাসন কখনো ছিল নির্বাচিত, কখনো অনির্বাচিত; তফাৎ ওইটুকুই। রাষ্ট্র ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে, বিশেষ ক্ষমতা আইন এসেছে, এসেছে জননিরাপত্তা আইন। ওই জননিরাপত্তা আইন রাষ্ট্রের চরিত্রটিকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে। এই আইন জনগণকে পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের হাতে তুলে দেবে; আর ক্ষমতা পেয়ে ওই দুই প্রতিষ্ঠান ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ টাউটরা জনগণকে অর্থনৈতিকভাবে নিপীড়ন করবে, তোলা তুলবে। আগেও তুলতো, কখনো থামায়নি, কিন্তু এখন তুলতে পারবে আরও সহজে, একবারে বৈধভাবে, ধরে এনে, কিংবা ধরে এনে জামিনের অযোগ্য করে কারাগারে মাসের পর মাস বন্দী করে রাখার হুমকি দিয়ে। এই রাষ্ট্র বস্তিবাসীকে উৎখাত করে; বলে, সন্দেহ হচ্ছে তোমরা খাঁটি সন্ত্রাসী, কিন্তু ব্যাংক লুট করা প্রকৃত ও খুনের মামলার আসামি যে সন্ত্রাসী তাকে সে পাহারা দেয়। এই রাষ্ট্র হুঙ্কারের, ধমকের ও হুকুমের; এর ভাষা জনগণের ভাষা, অর্থাৎ বাংলা ভাষা, হবে এ সম্ভাবনা বহুভাবেই ক্ষীণ।

স্বাধীনতার পরে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা ইংরেজিবিরোধী ছিল না, বরং ইংরেজির দিকেই ঝুঁকে পড়েছিল। কেননা, ক্ষমতায় এসেছে মধ্যবিত্ত, যে মধ্যবিত্ত পুঁজিবাদকেই আদর্শ মনে করে এবং শ্রেণিগতভাবে যারা মোটেই উপনিবেশবাদের বিরোধী নয়। এরা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পছন্দ করে। কেননা, আমলাতন্ত্র এদের নিয়েই গঠিত। পুঁজিবাদে এদের সুবিধা, কারণ ওই পথেই ধনী হওয়ার সম্ভাবনা। পরের নেতৃত্ব আগের নেতৃত্বকে ছাড়িয়ে গেছে এক ব্যাপারে, সেটা হলো পুঁজিবাদের জন্য পথ প্রশস্তকরণ। আর ওই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভাষা তো বাংলা নয়, তার ভাষা হচ্ছে ইংরেজি।

রয়েছে নির্ভরতা। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের রাষ্ট্র মোটেই স্বাবলম্বী নয়, বরং তার পরনির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। ঋণ-সাহায্য এনজিও তৎপরতা, সবই রয়েছে পুরোদমে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারিত হয় ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফ-এর নির্দেশ অনুযায়ী, এদের ভাষা বাংলা নয়। বাঙালি এখন জীবিকান্বেষণে ও শিক্ষা লাভের আশায় বিদেশে যেতে পারলে যত খুশি হয়, তত খুশি কম জিনিসেই হয়ে থাকে। এ জন্য তাকে ইংরেজি শিখতে হয়।

দেশের ভিতরে ধনীগৃহের সন্তানেরা ইংরেজির মাধ্যমেই পড়াশোনা করে। ঢাকা শহর এখন ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার চেয়ে কম যায় না, ইংরেজি শিক্ষার উন্মাদনায়। বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে; এই সৌভাগ্য তার জন্য দুর্ভোগের কারণ হবে বলে আশঙ্কা, কেননা নতুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে, এই সম্পদ দখল করার অভিপ্রায়ে। একাত্তরে আমেরিকা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোরতর বিরোধী, সেই আমেরিকাই হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির প্রধান ভরসা। আসল সত্য এই যে, বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি অন্য কিছু দেখে না, নিজের স্বার্থ ছাড়া। বাংলাদেশের বাজার তারা বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে, দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করছে এবং দেশে সম্পদ যা আছে তাও বিদেশিদের হাতে নির্বিচারে ও সোৎসাহে তুলে দিচ্ছে। শাসকশ্রেণির একাংশ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে, অন্য অংশ বলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে তাদের ধ্বনি একেবারেই অভিন্ন; সেক্ষেত্রে কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, আর কে নয়, তা নিরূপণ করা একেবারেই অসম্ভব। বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্র কথা বলছে তার নিজের ভাষায়, জনগণের স্বার্থের যে ভাষা, অর্থাৎ বাংলাভাষা, সে-ভাষায় নয়।

শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাভাষার অবস্থা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে তৈরি হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে। এ-শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই যে স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাবে তা নয়, অনেকেই দেশে থেকে যাবে এবং আগামী দিনে আমলাতন্ত্রের উচ্চতর স্তরে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, বিভিন্ন পেশায় এবং রাজনীতিতেও এরা নেতৃত্ব দেবে। ওই নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখনই ইংরেজি-মিশ্রিত বাংলায় কথা বলে, ভবিষ্যতে মিশ্রণটা থাকবে না, ইংরেজিতেই কথা বলতে পছন্দ করবে। এবং যারা পারবে না তারা নিজেদের হীনজ্ঞান করা শুরু করবে। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলো অবশ্যই শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রধান ধারা। কিন্তু এই ধারা ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে। অন্যদিকে মাদরাসা শিক্ষাকে জোরদার করা হচ্ছে। এই ধারায় বাংলাভাষা চর্চা কম এবং এখানে যারা শিক্ষিত হচ্ছে পরবর্তীকালে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, রাষ্ট্রকে আরও দক্ষিণ দিকে ঠেলে দিতে চাইবে, এমন আশঙ্কা মোটেই অমূলক নয়। আসলে মাদরাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করা আর গরিব মানুষকে আরও গরিব করার চেষ্টা যে-রাষ্ট্রীয় অভিপ্রায়, তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই বরং বলা যায় এরা একই সূত্রে গ্রথিত। গরিবের সন্তানই মাদরাসায় পড়ে এবং পরবর্তী জীবনে জীবন-সংগ্রামে ব্যর্থ হয়ে এরা আরও গরিব হবে। কেননা, তাদের শিক্ষার কোনো অর্থনৈতিক মূল্য তারা দেখতে পাবে না, ধর্মীয় কাজে আর ক’জনের কর্মসংস্থান হবে? শিক্ষা ক্ষেত্রে এই যে বৈষম্য একে অস্বাভাবিক বলার কোনো উপায় নেই। বরং বলতে হবে যে এটাই স্বাভাবিক। কারণ সমাজে বৈষম্য রয়েছে এবং রাষ্ট্রে সেই বৈষম্যকে মহোৎসাহে বিকশিত করছে ও কায়মনোবাক্যে পাহারা দিচ্ছে এবং সেই বৈষম্যই স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে এসেছে শিক্ষা ব্যবস্থাতে।

দুই

উচ্চতর শিক্ষায় বাংলাভাষা চালু করা হবে বলে আশা করা হয়েছিল। সেই আশা এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর কারণও ওই একই। যে রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা নয়, সে রাষ্ট্র উচ্চশিক্ষায় বাংলা প্রচলনের জন্য চেষ্টা করবে কেন? নির্মম সত্য এই যে, উচ্চবিত্তদের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা ইংরেজিতেই লাভ করবে বলে আশা রাখে। কেউ কেউ বিদেশেই যাবে। যারা যাবে না তারাও ব্যক্তিমালিকানাধীন তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো বটে, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ইংরেজির মাধ্যমেই শিক্ষিত হবে। উচ্চবিত্তরাই সমাজের নেতা, তারাই আদর্শ, অন্যরাও তাদের পথেই চলতে চাইবে, চলতে ব্যর্থ হলে ব্যর্থতার দুঃখে কপাল ঠুকবে।

বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি লোকের বাস। সারা বিশ্বে বাংলাভাষীর সংখ্যা বিপুল, বাংলা ভাষার উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা কোনো অসম্ভব কাজ ছিল না। তার জন্য প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রীয় উদ্দীপনা ও বিনিয়োগের। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন বই লেখার, বাইরের বিশ্বে যা লেখা হচ্ছে সেগুলো অনুবাদ করার। কাজটা প্রকৃত অর্থে বলতে গেলে শুরুই হয়নি; যে জন্য এখন বাংলা ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে অর্থনীতি। মধ্যবিত্তের একাংশ নিম্নমধ্যবিত্তে পরিণত হয়েছে, নিম্নমধ্যবিত্ত আরও নিচে নেমেছে, প্রান্তিক কৃষক পরিণত হয়েছে ভূমিহীনে, ভূমিহীন হয়ে পড়েছে ভিটাহীন। সব কিছুই ঘটেছে উন্নতির অন্তরালে। বস্তুত উন্নতির প্রচন্ড চাপের কারণেই। এই যে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ, এদের জীবনে কোনো ভাষা নেই, নীরব ক্রন্দন ও আর্তনাদ ছাড়া। রাষ্ট্রভাষা থেকে এরা অনেক দূরে, রাষ্ট্রের ভাষা থেকে তো অবশ্যই। রাষ্ট্রের ভাষা এদের সন্ত্রস্ত রাখে এবং রাষ্ট্রভাষার চর্চা যে করবে, তেমন সুযোগ এরা পায় না।

আমাদের দেশে সবচেয়ে শক্তিশালী গণমাধ্যম হচ্ছে টেলিভিশন; টেলিভিশন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে চলে, রাষ্ট্রের শাসন কর্তৃত্বে পরিবর্তন ঘটে, একদল যায় আরেক দল আসে, কিন্তু টেলিভিশনের ভাষা সেই একই থাকে, সেটি রাষ্ট্রের ভাষা, অর্থাৎ শাসকশ্রেণির ভাষা। শাসকশ্রেণি তাদের মাহাত্ম্যের কথা বলতে থাকে। একবার এ দল বলে আরেকবার বলে অন্যদল। পার্থক্য এটাই। জনগণের কথা বলে না। কখনো নয়, কোনো অবস্থাতেই নয়। সংবাদপত্রগুলোও শাসকশ্রেণির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বটে; হয় এ-দলের নয় তো ও-দলের যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তাদের কর্তৃত্ব বাড়ে, স্বভাবতই।

রাষ্ট্রের আদর্শ পুঁজিবাদী কিন্তু এই রাষ্ট্রে আবার সামন্তবাদকেও উৎসাহিত করে, নিজের স্বার্থে। ধর্মকে নিয়ে আসে রাজনীতিতে। এর একটা কারণ, রাষ্ট্রের যারা শাসক তারা স্থূল অর্থে বস্তুতান্ত্রিক অবশ্যই, যা পায় তাই খায়, কিন্তু দার্শনিক অর্থে ইহজাগতিক নয়, পরকালের কথা ভাবে এবং ইহকালে যেসব সুখ-সুবিধা পাচ্ছে সেগুলো পরকালেও পাবে, পেতেই থাকবে, এই আশাতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অন্যদিকে জনগণকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য আবার ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান ও সান্ত¡না সরবরাহ করা হয়। আজকের বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি কোনো দল করে না। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল, বিএনপি তাকে সরিয়ে দিয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, তারা যে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুনঃস্থাপিত করবে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না, যাবেও না।

কী করতে হবে আমরা জানি। রাষ্ট্রকে জনগণের সম্পত্তি ও অবলম্বনে পরিণত করতে হবে অর্থাৎ তাকে গণতান্ত্রিক করার দরকার হবে, পৃথক অর্থে। সেটা যখন সম্ভব হবে তখন রাষ্ট্রের ভাষা এবং রাষ্ট্রভাষার মধ্যকার ব্যবধান দূর হবে; বাংলা হবে রাষ্ট্রের ভাষা, সর্বস্তরে তা চালু থাকবে। এই ভাষায় সৃষ্টিশীল কাজ হবে। বিশ্বের মানুষ একে মর্যাদা দেবে। জনগণের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি আসবে। রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন আনার লক্ষ্যেই তো আমরা আন্দোলন করেছি উনিশ শ বায়ান্নতে এবং একাত্তরে। একই আন্দোলন। আজ যে দেশে এত হতাশা তার কারণ ওই আন্দোলন এখন নেই। অথচ তার খুবই প্রয়োজন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিদ্যমান রাজনীতির প্রধান দুটি ধারা, যারা আসলে একই ধারা, তারা এই আন্দোলন করবে না। নতুন রাজনৈতিক ধারা দরকার হবে, সেই ধারা গণতান্ত্রিক হবে অর্থাৎ তাকে বাম দিকের হতে হবে, ডান দিকের না হয়ে।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর