রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

একই সুতোয় বাঁধা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন

ড. আতিউর রহমান

একই সুতোয় বাঁধা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন

মহান ভাষা আন্দোলনের র‌্যালিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যরা

একই সঙ্গে উদ্যাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মশতবার্ষিকী। বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছর আগে তাঁর জন্ম। কভিড-১৯ সংকটের কারণে ‘মুজিববর্ষ’ প্রলম্বিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের সূতিকাগার। যে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম তাতেই বিকশিত হয়েছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের উপলব্ধি এবং তাকে ঘিরে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচিন্তা। ১৯১১ সালে হঠাৎ করে ১৯০৫ সালে ভাগ হয়ে যাওয়া বাংলাকে ফের একত্রিত করায় পূর্ব-বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হতাশ হয়ে পড়েন। তাদের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির অগ্রগতির যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল প্রদেশ পূর্ব-বাংলায় তা ব্যাহত হলো। মুসলিম নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকারের এই সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়েছিলেন। সেই ক্ষোভ মেটানোর অংশ হিসেবেই ১৯১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ‘নাথান কমিশন’ গঠন করে ব্রিটিশ সরকার। ওই কমিশনের পর আরও কয়েকটি কমিটি ও উদ্যোগ নেওয়া হয়। অবশেষে ১৯২১ সালে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। উদার ও দক্ষ শিক্ষকদের পরিচর্যায় পূর্ব-বাংলার কৃষিনির্ভর মধ্যবিত্তের সন্তানেরাই এই অঞ্চলে মানুষের জন্য আলাদা আত্মপরিচয়ের পক্ষে আন্দোলন সংগ্রামের সূচনা করে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন এই বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথমে দানা বাঁধে। শেখ মুজিব এ আন্দোলনের একজন প্রথম সারির নেতা ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে তাই বাঙালি জাতির পিতার নাম বারে বারেই উচ্চারিত হতে দেখে অবাক হই না।

অবাস্তব রাষ্ট্র পাকিস্তানের শুরু থেকেই এলিট পশ্চিম পাকিস্তানিদের লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দাবিয়ে রাখা। তাই পাকিস্তানের সংকীর্ণমনা শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে দাফতরিক ও জ্ঞানচর্চার কাজকর্ম থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ প্রথম থেকেই এই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করে। এই আলোচনার পুরোধা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, ড. পৃথ্বীশ চক্রবর্তী, মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, আবুল কাশেম, নুরুল হক ভূঁইয়া, অজিত গুহ এবং অন্যান্যরা। এক পর্যায়ে এই আন্দোলন রাজপথে নেমে আসে। আর এর নেতৃত্বে থাকেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতৃবৃন্দ। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথমে গণতান্ত্রিক যুবলীগ এবং তারপর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রধান সংগঠক হিসেবে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তাছাড়া তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে মিলে অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে গঠিত প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম-পরিষদে’র বিভিন্ন কর্মসূচিতেও তিনি যোগদান করেন। তবে এরও বেশ আগে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পূর্ববঙ্গের ১৪ জন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী রাষ্ট্র-ভাষা দাবিসহ ২১ দফা দাবিসমেত একটি পুস্তিকা প্রচার করেন। (এম আবদুল আলীম রচিত ‘ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব - তারিখ ও ঘটনাপঞ্জি’, ‘অন্যদিন’, ঈদসংখ্যা ২০১৯, পৃষ্ঠা ৪২২)। এর দুটো দফাই ছিল রাষ্ট্র-ভাষা সংক্রান্ত। ১৯৪৭ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে প্রথম সভা হয় বাংলা ভাষা নিয়ে অপতৎপরতার বিরুদ্ধে। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেমের পরিচালনায় ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ছাড়াও অনেক রাজনীতিবিদ (এম আবদুল আলীম, ‘ভাষা আন্দোলন কোষ’, প্রথম খন্ড, কথা প্রকাশ, ২০২০, পৃষ্ঠা ৫৩৯)। ওই বছরের ১৫ নভেম্বর পাকিস্তান কর্মকমিশনের পরীক্ষার যে বিষয়-তালিকা প্রকাশ করা হয় তাতে বাংলা ভাষা ছিল না। এর কাছাকাছি সময়ে করাচিতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এসব অপতৎপরতার প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সভা এবং ৭ ডিসেম্বর সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাসেম এবং ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন এসব কর্মসূচিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৩৯ থেকে ৫৪০)। বাংলা ভাষার পক্ষে ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে কংগ্রেসদলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দেওয়া একটি প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি এই ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও বিভিন্ন স্কুলে (বশির আল হেলাল, ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’, আগামী প্রকাশনী, ২০০৩, পৃষ্ঠা ২৪৫)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। আইন বিভাগের ছাত্ররাও ক্লাস বর্জন করে এবং ছাত্রনেতা নঈমউদ্দীনের সভাপতিত্বে আরেকটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ পুনর্গঠিত হয় এবং ছাত্রনেতা শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করা হয়। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল (মাযহারুল ইসলাম রচিত ‘ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব’, আগামী প্রকাশনী, ২০১৭, পৃষ্ঠা ২০)। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের করা ৪ মার্চ, ১৯৪৮ এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র শেখ মুজিবের স্বাক্ষরে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে একটি লিফলেট বিতরণ করা হয়। ৫ মার্চ ফজলুল হক হলে পুনর্গঠিত ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১১ মার্চ প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট ডাকা হয়। ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে যে প্রস্তুতি সভা বসে তাতে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য ছাত্রনেতারা উপস্থিত ছিলেন। মূলত তাঁরই নেতৃত্বে পরের দিন কোন কোন স্থানে পিকেটিং করা হবে, কে কোথায় থাকবেন তা ঠিক করা হয়। ১১ মার্চ ধর্মঘট চলাকালে জনাব তোয়াহা, শেখ মুজিব, শামসুল হক, গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, শওকত আলীসহ ৬৯ জনকে আটক করা হয়। ১৪ জন পুলিশের আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে যান। প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ওইদিনই প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় (এম আবদুল আলীম ‘ভাষা-আন্দোলন-কোষ’ প্রথম খন্ড, কথা প্রকাশ, ২০২০, পৃষ্ঠা ৫৪২)। ১৩-১৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর ঢাকা আগমনের আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার প্রয়োজনে ১৫ মার্চ বর্ধমান হাউসে খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র প্রতিনিধিদলের সভায় ৮টি শর্তে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। 

১৬ মার্চ আমতলায় যে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত ছাত্রনেতা শেখ মুজিব (অলি আহাদ রচিত ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫’, পৃষ্ঠা ৫০)। সভায় কিছু সংশোধনী গৃহীত হয়। সেগুলো অলি আহাদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। সভা শেষে ছাত্ররা মিছিল বের করে। মিছিলে ছাত্রনেতা শওকত আলীসহ অনেকে আহত হয়। ওইদিন রাতেই ফজলুল হক হলে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৭ মার্চ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। ২১ মার্চ ঢাকায় নাগরিকদের সংবর্ধনার জবাবে জিন্নাহ জানালেন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবে। ছাত্ররা এতে ক্ষুব্ধ হন। তাই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিতব্য বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠান প্রথমে বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েও দেশের মর্যাদার কথা ভেবে পিছিয়ে আসেন। কিন্তু বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ একই কথা বললেন। উপস্থিত ছাত্রদের অনেকেই ‘না না’ বলে প্রতিবাদ জানালেন (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১১৪)। ২৪ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র নেতৃবৃন্দসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে জিন্নাহর একাধিক সভা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও বাংলা ভাষার পক্ষে জোরদার অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কার্জন হলে অনুষ্ঠিত প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এক ঐতিহাসিক উচ্চারণের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্বোধন করা হয় বলা চলে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আশ্চর্যের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। যা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়ে ছিলেন যে, মালা তিলক টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো নেই।’ এরপর ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। আমতলায় ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমউদ্দীনের সভাপতিত্বে যে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে শেখ মুজিব এবং দবিরুল ইসলাম বক্তৃতা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনের সঙ্গে তারা একাত্মতা প্রকাশ করেন। এই আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ার জন্য শেখ মুজিবসহ অনেককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে গ্রেফতার এবং পরে বহিষ্কার করা হয়। মুচলেকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যাওয়ার সুযোগ দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি (শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ইউপিএল, নবম প্রকাশ, ২০১৯, পৃষ্ঠা ১১১ থেকে ১১৫)।

আরবি হরফে বাংলা লেখা নিয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষক উপদেষ্টা বোর্ডের অপচেষ্টার বিরুদ্ধেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গণপরিষদে পাকিস্তানের ‘মূলনীতি’ কমিটির প্রতিবেদন পেশ করেন। ওই প্রতিবেদনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উল্লেখ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ পূর্ববাংলার সচেতন নাগরিকরা খুবই ক্ষুদ্ধ হন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে পূর্ববঙ্গ সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখের স্বাক্ষরে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয় ১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি (এম আবদুল আলীম ‘ভাষা-আন্দোলন-কোষ’-প্রথম খন্ড, প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৫৪৪)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে যখন আন্দোলন চাঙা হয়ে উঠেছিল তারই মাঝে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। প্রতিবাদে ২৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খানের সভাপতিত্বে¡ এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ৩০ জানুয়ারি প্রতীকী ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। ৩০ জানুয়ারি আমতলাতে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান ওঠে। উল্লেখ্য, এই সময়ে সাবেক ছাত্রনেতা এবং পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। খালেক নেওয়াজ খান, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহাসহ অনেকেই এই সময়ে তাঁর সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করেন এবং আন্দোলনের কর্মপন্থা নিয়ে শলাপরামর্শ করেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা দেখা করতে এলেন। ... আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। ... রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দা দিয়ে ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। ... বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে।” ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন এবং একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে ছাত্রনেতাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। তিনি আরও জানিয়েছিলেন যে, ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করবেন। সে কারণে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং পরে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। তবে তিনি অনশন ধর্মঘটের প্রতিশ্রুতি ঠিকই রেখেছিলেন। সেই মতো তিনি এবং মহিউদ্দিন ফরিদপুর জেলে অনশন শুরু করেছিলেন। এদিকে তাঁর পরামর্শ মতো কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে রূপান্তরিত করে ফেলেন। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত অমান্য করেই তারা ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ওই দিন গাজিউল হকের সভাপতিত্বে আমতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রসভার পর পরিষদ ভবনের দিকে যেতে থাকেন ছাত্ররা। আর তখনই পুলিশের গুলিতে জব্বার ও রফিক এবং দ্বিতীয় দফা গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত শহীদ হন। এরপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা এই আন্দোলনে আরও সক্রিয় হন। সারা প্রদেশে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী ও অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়াও অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। এর পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামের এক ঐতিহাসিক সংকলন প্রকাশ করা হয়। আর এভাবেই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করেন। ভাষা আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক এই প্রেক্ষাপটেই গড়ে ওঠে পূর্ববাংলার জনগণের অর্থনৈতিক চাওয়া-পাওয়ার আন্দোলন। তার পুরোভাগে ছিলেন মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবসহ আরও অনেকে। তবে সবাইকে ছাপিয়ে নেতৃত্বের গুণে তরুণ সংগঠকদের (যাদের বেশিরভাগই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী) চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন শেখ মুজিব। তিনি তাঁর সাংগঠনিক শক্তির জোরে আওয়ামী লীগকে গড়ে তোলেন। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়নের স্বার্থে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর আন্দোলনকে তিনি বেগবান করেন। এজন্য তাঁকে বারে বারে জেলে যেতে হয়। ‘ছয় দফা’ কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি বাঙালির ত্রাতার আসনে বসেন। তাই তাঁকে প্রথমে জেলে এবং পরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে শেষ করে দেওয়ার পাঁয়তারা করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ছাত্র-জনতার ব্যাপক সংগ্রামে তিনি ওই মামলা থেকে মুক্ত হয়ে তাদের দেওয়া জন-উপাধি বঙ্গবন্ধু লাভ করেন।  এর পরের ইতিহাস আমাদের জানা। বাঙালি পিতার এই সংগ্রামমুখর রাজনৈতিক অভিযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ অংশ  হয়ে আমাদের ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। যোগাযোগ : [email protected]

সর্বশেষ খবর