১২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১৪:৩৮

নতুন কর নীতি চালুর আগেই ভুটান ভ্রমণে বাংলাদেশি পর্যটকদের ঢল!

দীপক দেবনাথ, ভুটান থেকে

নতুন কর নীতি চালুর আগেই ভুটান ভ্রমণে বাংলাদেশি পর্যটকদের ঢল!

বাংলাদেশি পর্যটক। ছবি: দীপক দেবনাথ

ভ্রমণ পিপাসু বাঙালি বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। প্রতিবছরই নিয়ম করে বিদেশ ভ্রমণ করে থাকেন তারা। সেই তালিকায় ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটান।

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর বিয়ের ৪৫ বছর পূর্তি হয় ঢাকার বাসিন্দা এম ভি মালিক ও আফরোজা দম্পতির।

এ উপলক্ষে নিজের সন্তানরাই বাবা-মাকে সারপ্রাইজ গিফট হিসেবে ভুটানে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক না কেন, তা আর হয়ে উঠছিল না। 

কিন্তু ভুটান ভ্রমণ নিয়ে সে দেশের সরকারের এক প্রস্তাবিত কর নীতির ফলেই রাতারাতি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়ে ভুটানে পাড়ি দেন মালিক দম্পতি।

ঢাকা থেকে বিমানযোগে মেয়ে পারিসাকে  নিয়ে ৯ ডিসেম্বর ভুটানের পারো বিমানবন্দরে নামেন তারা। এরপর সেখান থেকে সোজা চলে যান পারো উপত্যকায় কয়েক হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত তাকসং বৌদ্ধ মন্দির দর্শনে। সেখানে ওই দম্পতির সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিনিধির।

ভুটানের মাটিতে নিজের দেশের একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকার (বাংলাদেশ প্রতিদিন) প্রতিনিধির সাক্ষাৎ পেয়ে খানিকটা অবাক হন তারা।

এরপর কথা প্রসঙ্গে ঢাকার বাসিন্দা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এম ভি মালিক জানান, “এই সময় ভুটানে আসার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। এক বছর ধরেই আমরা পরিকল্পনা করে আসছি যে ভুটানে যাব। কারণ গত বছর আমাদের মেয়েরা এই ট্রিপটা আমাদেরকে দিয়েছিল। কিন্তু সুযোগ না থাকায় আমরা আসতে পারছিলাম না। যখনই জানতে পারলাম যে জানুয়ারি মাস থেকে ভুটান সরকার নতুন ভ্রমণ কর চালু করতে চলেছে, ৩-৪ দিনের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে আমরা এখানে চলে এসেছি।”

প্রস্তাবিত এই পদক্ষেপ ভুটান সরকারের কতটা কাজে লাগবে সেটা না বলতে পারলেও পর্যটকদের ক্ষেত্রে যে ভালো নয় সেটা নিশ্চিত। তিনি বলেন, “ভুটান সরকারের জানা উচিত যে, একটি সুন্দর দেশ বলেই পর্যটকরা বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে ঘুরতে আসেন। এখানকার হোটেলে থাকি। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখি। অনেক কিছু কেনাকাটা করি। এতে ভুটান সরকারের রাজস্ব আয় হয়। কিন্তু সেই রাজস্ব আয় কমে গেলে ভুটান সরকারের ক্ষতি। আমার মতে পর্যটকদের দিকে তাকিয়ে সরকারের উচিত পুনর্বিবেচনা করা।

আগামী ১৩ ডিসেম্বর তিনি ভুটান ছেড়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে পাড়ি দেবেন বলেও জানান মালিক। 

জানা গেছে, ভুটানে ভ্রমণরত বাংলাদেশ, ভারত ও মালদ্বীপের পর্যটকদের জন্য ভিসা ফি বাবদ ৪০ ডলার (একবার) এবং যতদিন তারা ভুটানে অবস্থান করবেন ততদিনের জন্য দিনপ্রতি টেকসই উন্নয়ন ফি বাবদ দিতে হবে ৬৫ ডলার করে।

এর আগে এই তিনটি দেশেরই ভুটান ভ্রমণের কোনও ফি দেওয়া লাগত না। কিন্তু ডিসেম্বরই দেশটির ক্যাবিনেটে বিলটি পাস হওয়ার কথা রয়েছে।

মালিকের স্ত্রী মাহফুজা জানান, “ভুটানে আগামী বছর থেকে ভিসা বাবদ চার্জ বাড়াবে। আমার মেয়ে আমাকে বলেছে যে আম্মু তাড়াতাড়ি যাও। আমার মেয়ে আমাদেরকে মারেজ এটা গিফ্ট করেছে। এক বছর আগেই এই গিফট করা হয়েছিল কিন্তু আমরা গত এক বছর ধরে এখানে আসতে পারছি না। যখন শুনলাম যে আগামী বছর থেকে এই ভিসা চার্জ বাড়বে তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এবং মঙ্গলবার এখানে চলে এসেছি তাড়াহুড়ো করে।”

ভুটান সরকারের নতুন কর নীতির ফলে পর্যটক সংখ্যা কমবে বলেও মনে করেন তিনি। মাফুজা বলেন, “আমরা যারা সাধারণ মানের পর্যটক আমরা প্রতিবছর কিছু অর্থ জমিয়ে রেখে বিদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা করে থাকি। বিদেশে যাওয়া, থাকা, খাওয়ার খরচ জোগাড় করতে পারলেই আমরা সেখানে বেরিয়ে যাই কিন্তু সেখানে যদি অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়, সেটা আমাদের পক্ষে খুবই কষ্টকর।”

ওই দম্পতির কন্যা পারিশা জানান, “আব্বা আম্মু ঘুরতে পছন্দ করেন, তাই আমরা ভাইবোনেরা গিফট হিসেবে ভুটান ভ্রমণের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম ভুটান তাদের খুব পছন্দের জায়গা হবে।” 

ভুটান ভ্রমণের কারণ হিসেবে তিনি জানান, “কর নীতি বাড়ানোর প্রস্তাবটা শুনে আমরা তাড়াহুড়ো করে ভুটানে চলে এসেছি।  
প্রস্তাবিত কর নীতির ফলে আমার ধারণা বাংলাদেশ থেকে আসা পর্যটকদের সংখ্যা কিছু মাত্রায় হলেও কমবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাবে।”

ঠিক একই কারণে তড়িঘড়ি করে ভুটান ভ্রমণের স্বাদ পেতে ছুটে এসেছেন ঢাকার বাসিন্দা মুহম্মদ শাহরিয়ার বিপুল। ভুটানের পারো শহরের একটি হোটেলে তার সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি জানান, “বাংলাদেশিরা অন-অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে ভুটান ভ্রমণ করতে পারত। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতীয় এবং মালদ্বীপ বাসীরাও ভুটান বেড়াতে আসেন। প্রস্তাবিত কর নীতি চালু হলে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের ওপর আঘাত হানবে।” 

তার দাবি, “ভুটান এমনিতে একটু ব্যয় বহুল শহর। তার উপরে যদি অতিরিক্ত কর ৬৫ ডলার দিতে হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের ক্ষেত্রে আরও খরচ সাপেক্ষ হয়ে যাবে।”

গত ৫ তারিখে ঢাকা থেকে ভুটানে আসেন তিনি। ঢাকা থাকাকালীন কর বৃদ্ধির বিষয়টি জানতে পারেন। কিন্তু নিশ্চিত ছিলেন না। এ ব্যাপারে বিপুল জানান, ভুটানে পা রাখার পর এই বিষয়টি নিয়ে জানতে পারলাম যে আগামী বছরের শুরু থেকেই ভুটান সরকার এই নতুন ভ্রমণ কর নীতি চালু করতে চলেছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ, ভারত এবং মালদ্বীপ সরকারের কাছে ভুটান সরকারের সঙ্গে আলোচনা করারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। 

ভুটান ভ্রমণের পরিকল্পনা হিসেবে বাংলাদেশি নাগরিক পারভিন আক্তার মেঘলা জানান, “এখানে অতিরিক্ত কোনও কর ছিল না। কম খরচে ভুটান সফর সেরে ফেলা যায়। সেক্ষেত্রে কর হার বৃদ্ধির ফলে ভুটানকে বাদ দিয়ে হয়তো অন্য কোনও রাষ্ট্রকে পছন্দ করতে হবে। সরকারের কাছে তার আবেদন পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর পর্যটকদের ক্ষেত্রে যেন এই অতিরিক্ত কর চাপানো না হয়।”

তাড়াহুড়ো করে এই শহরটা করা ঘুরে দেখা হল বলেও জানান তিনি। সেক্ষেত্রে আমরা খুবই ভাগ্যবান যে নতুন খরচ আরোপের আগে আমরা এই সফর করে যেতে পারছি।

কেউ কেউ বলছেন, অতিরিক্ত পর্যটক আসার কারণে ভুটানের দূষণ বাড়ছে। ইতোমধ্যেই বিশ্বের দূষিত নগরীর মধ্যে স্থান পেয়ে গেছে ঢাকা-দিল্লি কলকাতার মত শহরগুলো। আর সেই দূষণ কমাতে ভুটান সরকার নতুন ভ্রমণ কর নীতি চালু করতে চায়, যাতে পর্যটক সংখ্যা কিছুটা কমে। পর্যটক কমলে মানুষের আনাগোনা কমবে, গাড়ির সংখ্যা কমবে, কমবে পরিবেশ দূষণ। বাঁচবে সবুজায়ন।

যদিও ভুটান সরকারের নিয়ম মানতে রাজি নন পারভিন। তিনি জানান, “ভুটান পরিচ্ছন্ন সুন্দর একটি রাষ্ট্র। ওরা চাইবে ওদের শহরগুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে। কিন্তু পর্যটকদের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে কিভাবে এই পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা যায়-যেটা আগে তারা করে এসেছে। কিন্তু সরাসরি এ রকমভাবে পর্যটকদের না করে দেওয়াটা মেনে নেওয়া যায় না।”

শুভ চন্দ্র দাস নামে এক বাংলাদেশি পর্যটক জানান, “এখনও পর্যন্ত গত তিন/চার দিন ধরে ভালোই উপভোগ করেছি। খরচ মোটামুটি সাধ্যের মধ্যে। কিন্তু আগামী বছরের জানুয়ারি মাস থেকে নতুন কর চালু করতে চলেছে ভুটান সরকার। প্রতিদিন ৬৫ ডলার করে নতুন কর দিতে হবে। তার অভিমত ইউরোপের দেশগুলোর পর্যটকদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হলেও সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এই নীতি চালু করা উচিত নয়। এর ফলে ভুটানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশি পর্যটকরা ভারতসহ অন্যান্য দেশগুলোতে ভ্রমণ করতে চলে যাবেন বলে মনে করেন তিনি। 

ভুটান সরকারের এই নতুন কর নীতি ভারতীয় পর্যটকদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন ভারতের কেরালা থেকে ভুটানে বেড়াতে আসা পর্যটক নিসলু রহমান। তিনিও জানান, নতুন করে এই কর নীতি চালুর আগেই তিনি ভুটান সফরে এসেছেন। 
 
যদিও এ ব্যাপারে ভুটানের ফুন্টসিলিংয়ে অবস্থিত “এজ ভুটান ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস” এর তরফে এম সাঙ্গি এই তিন দেশের পর্যটকদের আশ্বস্ত করে জানান, “ভুটান সরকার এ ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। মন্ত্রিসভায় এই বিলটি এখনও খসড়া আকারে আছে। কিন্তু সরকার পর্যটকদের উপর কিছু পরিমাণ অর্থ চাপাতে পারে।  তবে এই নিয়ে এখনই চিন্তার কিছু নেই।  আমি সবাইকে আহ্বান জানাব তারা যেন এখনই ভুটানে আসা বন্ধ না করেন। যে কোনও মৌসুমে তারা আসতে পারেন এবং এই দেশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।”

তিনি আরও জানান, “আমাদের দেশের প্রধান লক্ষ্যই হল হাই ভ্যালু লো ভলিউম।”

এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি জানান, “ভুটান সরকার   আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে যায়।”

বিডি প্রতিদিন/কালাম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর