শনিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
বীরপ্রতীক সিতারার আক্ষেপ

‘মুক্তিযুদ্ধের দলিলে কর্নেল হায়দারের নাম কোথাও নেই’

প্রতিদিন ডেস্ক

বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত জীবিত একমাত্র নারী মুুক্তিযোদ্ধা ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) সিতারা রহমান (৭৩) আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর রমনার রেসকোর্সে পাক হায়েনাদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন আমার ভাই লে. কর্নেল এ টি এম হায়দার বীরউত্তম। অথচ ইতিহাসের কোথাও তার নাম নেই। এমনকি ঢাকা সেনানিবাসেও দেখিনি। বিজয় দিবস এলেই এটি আমাকে খুবই পীড়া দেয়।’ খবর : এনআরবি নিউজের।যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী কিশোরগঞ্জের সন্তান সিতারা রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা এখন কিছুটা হলেও সম্মান পাচ্ছেন। ভাতাও পাচ্ছেন নিয়মিত। এসব জেনে খুবই ভালো লাগে। নিজেকেও সম্মানিতবোধ করি। সে কারণেই আশা করছি যে, সঠিক ইতিহাসের স্বার্থেই কর্নেল হায়দারের নাম আত্মসমর্পণের সেই ঐতিহাসিক দলিলে লিপিবদ্ধ করা হবে।

তাহলেই কর্নেল হায়দারের আত্মা শান্তি পাবে।’

সিতারা রহমান পরিবারসহ বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যের কালামাজো সিটিতে। ৪৮তম বিজয় দিবস উপলক্ষে তার অভিমত জানতে চাইলে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে এবং করছে। তা জেনে এবং দেখে খুবই ভালো লাগে। তবে সবাই রাজধানীমুখী হওয়ায় যানজটে দৈনন্দিন কর্মঘণ্টার বড় একটি অংশের অপচয় ঘটছে, এটির অবসানে সবার মনোযোগী হওয়া দরকার। গাড়িতে বসে অলস সময় অতিবাহিত করার ভিতর দিয়ে মানুষের আয়ু কমছে। অর্থাৎ মানবকল্যাণে অঙ্গীকারাবদ্ধরাও অনেক কিছু করতে সক্ষম হচ্ছেন না। আমি সরকারের প্রতি আহ্বান রাখছি, ঢাকায় যানজটের অবসানে বিকল্প সড়ক নির্মাণের জন্য। এই সঙ্গে সচিবালয়সহ কয়েকটি অফিস সরিয়ে নেওয়ার জন্যও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তাহলেই বিজয়ের প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার পথ আরও সুগম হবে।’

উল্লেখ্য, সিতারা রহমান ১৯৪৫ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। দুই ভাই আর ৩ বোনের মেঝো তিনি। তার বাবা কিশোরগঞ্জে আইনজীবী ছিলেন। সেই সুবাদে সেখানেই বসবাস করেছেন। কিশোরগঞ্জ থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর ঢাকায় হলিক্রস কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন মেধাবী ছাত্রী সিতারা। তিনি লেখাপড়া করেন মেডিসিনে। এমবিবিএস করার পর ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যোগ দেন লেফট্যানেন্ট হিসেবে। তাকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পোস্টিং দেওয়া হয়। একই সময়ে তার বড়ভাই মেজর হায়দারকে পাকিস্তান থেকে বদলি করা হয় কুমিল্লায়। মেজর হায়দার কুমিল্লায় থার্ড ব্যাটালিয়ন কমান্ডোতে যোগদান করেন। একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে ঈদ উদযাপনের জন্য ভাই-বোন মিলে কিশোরগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে যান। সে সময় সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। যানবাহন চলাচল বন্ধ। থমথমে ভাব সর্বত্র। কর্মস্থল থেকে সবাই পায়ে হেঁটে বাড়িতে ফিরছেন। ভাই-বোনের ছুটি শেষ হয়নি। তেমনি অবস্থায় মেজর হায়দার বোনকে নির্দেশ দিলেন কর্মস্থলে না ফিরতে। পাক হানাদারেরা বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পরই হায়দারসহ অনেকেই বিদ্রোহ করেন। গেরিলা দল গঠন করেন ভারতে গিয়ে। সেই দলের কয়েকজনকে পাঠান নিজ বাড়িতে মা-বাবা-ভাই-বোনদের পার্শ্ববর্তী মেঘালয় রাজ্যে নেওয়ার জন্যে। কিশোরগঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটে ভারতের মেঘালয়ে পৌঁছতে দুই দিন সময় লেগেছে তাদের। সেখানে স্থাপন করা হয় ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল।’ সেটি ছিল টিনের ঘরে। মেঝে পাকা ছিল না। ৪০০টি বিছানা পাতা হয়। এর কমান্ডিং অফিসার নিযুক্ত হন ডা. সিতারা। তার অধীনে ছিলেন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজেন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র-ছাত্রীরা। যুক্তরাজ্য থেকে আসা কয়েকজন চিকিৎসকও সেই হাসপাতালে যোগদান করেন। ডা. সিতারা এই হাসপাতালের ওষুধপত্র, সাজ-সরঞ্জাম আনতে মাঝেমধ্যেই আগরতলায় যাতায়াত করতেন। এই হাসপাতালে একটি অপারেশন থিয়েটারও ছিল। এর মেঝে ঢাকা হয় প্লাস্টিক দিয়ে। সেখানে শুধু বাঙালি মুক্তিবাহিনীকেই চিকিৎসা করা হয়নি, একই সঙ্গে মিত্রবাহিনীর আহতরাও চিকিৎসা নেন। হতাহতদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত থাকাবস্থায়ই সিতারা আকাশবাণী কলকাতা রেডিওর মাধ্যমে বিজয় অর্জনের তথ্য জানেন। তারা সবাই ফেরেন মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। অসাধারণ এই বীরত্বের জন্য সিতারাকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। তবে তিনি স্বাধীন দেশে বেশি দিন থাকেননি। স্বামী এবং নিজের পেশাগত কারণে ১৯৭৩ সালেই পাড়ি দিয়েছেন আমেরিকায়। উঠেছিলেন মিজৌরিতে। এরপর সিনসিনাটি, ওহাইয়ো এবং সর্বশেষ মিশিগানে বসতি গড়েছেন। তার ২ ছেলে এবং এক কন্যার সবাই আমেরিকায় জন্মগ্রহণ করেছেন। তারা ফেডারেল প্রশাসনে উচ্চপদে কর্মরত। সব কিছু নিয়ে ভালোই কাটছে সিতারার দিনকাল। তবে প্রায় প্রতি বছরই তিনি বাংলাদেশে যান ডাক্তার স্বামীকে নিয়ে। বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করেন এলাকার মানুষের।

সিতারা বলেন, একটি কিডনি ফেলে দিয়েছি। এখন একটি কিডনি নিয়েই বেঁচে আছি এবং বয়সের কারণে মাঝেমধ্যেই চেকআপ করাতে হচ্ছে।

এমনি অবস্থায় বীরপ্রতীক তারামন বিবির মৃত্যু সংবাদে সিতারা মর্মাহত এবং তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন। বাংলাদেশের সব মুক্তিযোদ্ধাকে ঐক্যবদ্ধ থাকার অনুরোধ জানিয়ে সিতারা বলেন, সবারই এখন চিরবিদায়ের পালা। তাই স্বপ্নের মতো বাংলাদেশ গড়তে ঐক্যের বিকল্প নেই। তাহলেই জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধের সার্থকতা আসবে।

সর্বশেষ খবর