মঙ্গলবার, ১৭ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

মানববন্ধু শেখ মুজিব

জাকারিয়া চৌধুরী

বাংলাদেশ। মুজিব দেশ বললে অত্যুক্তি করা হবে না। কিন্তু যত্রতত্র যেখানে সেখানে যে কেউ তার নাম ভাঙিয়ে স্বার্থ আদায়ের প্রবণতা আমার মনকে পীড়া দেয়। এতে করে বঙ্গবন্ধুর আকাশচুম্বী ভাবমূর্তি খর্ব করা হয়। বাংলাদেশ বলে কোনো স্বাধীন দেশের উত্থান অতীত ইতিহাসে ঘটেনি। তবে আমাদের ভূখন্ডে বাঙালি কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সংগীত, ধর্ম ও দর্শনকে কেন্দ্র করে জাতীয় চেতনা ও স্বকীয়তা হাজার বছরের পুরনো। আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে মেলবন্ধন ঘটেছে বহু বর্ণের বহু জাতের বহু চিন্তাধারার বহু মানুষের। আমরা চিন্তা-চেতনা ও রক্তধারায় এক অনন্য শঙ্কর জাতি। মেধায় ও মননে খুবই সমৃদ্ধিশালী। বহু জ্ঞানী-গুণী ও আধ্যাত্মিক সাধকের আবির্ভাব ও সমাগম ঘটেছে এই দেশের উর্বর মাটিতে। অখ- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ও জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষনেতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলে মন্তব্য করেছিলেনÑ ‘বাঙালিরা চিন্তার ক্ষেত্রে ভারতের আর সবার চেয়ে অগ্রণী।’

ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ এই উপমহাদেশে বহু উন্নতমানের ভাষা ও সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও বাংলার রবি ঠাকুর ছাড়া কারও ভাগ্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জোটেনি। বহু গুণাবলি সত্ত্বেও আমাদের প্রতিভা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারেনি রাজনৈতিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে। শত শত বছরের চাপা পড়ে থাকা আমাদের জাতিসত্তাকে মুক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু তার অপরিসীম সংগ্রাম, ত্যাগ এবং তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ জাতির বিশাল রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। লাখ লাখ যুবক শহীদ হয়েছে, লাখ লাখ নারী নির্যাতিত হয়েছে, অনেক রক্ত ও অশ্রু ঝরেছে আমাদের এই যুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু আমার দৃষ্টিতে বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা, বাঙালি জাতিসত্তার মুক্তিদাতা এবং পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের জনক। শুধু ইংরেজ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটানো মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য ছিল একটি আদর্শিক জাতিরাষ্ট্রের সূচনা যা বঙ্গবন্ধু করে যেতে পারেননি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে নিজে ও পরিবারের, এক হাসিনা ও রেহানা ছাড়া, প্রায় সবাই প্রাণ হারিয়ে। আওয়ামী লীগের এক অংশের ষড়যন্ত্র ও কিছু নেতার নীরব সমর্থন ছাড়া এই নৃশংস হত্যাকা- সম্ভব হতো না। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ও যুদ্ধোত্তরকালে গড়ে ওঠা রক্ষীবাহিনী কোথায় ছিল ইতিহাসের এত বড় জঘন্য হত্যাকান্ডের সময়ে ও পরে? কোনো প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ কিছুই উচ্চারিত হতে দেখিনি তখন। ওই হত্যাকান্ডের সময়ে আমি ইতালিতে ছিলাম। এ খবর পাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে উড়াল দিলাম লন্ডনে। ভাবলাম লন্ডন থেকে দেশের খবরাখবর পেতে সহজ হবে। ভেবেছিলাম আওয়ামী লীগ নিশ্চয় এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। উল্টো দেখি গাদ্দার মোশতাকের আনুগত্যে তাদের সরকার গঠন। আমি আওয়ামী লীগ করি না। কিন্তু আওয়ামী লীগের তখনকার কর্মকান্ডে আমি হতাশ ও ব্যথিত হই।

১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল মিটিং ডাকা হয় পার্টির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন জোহরা তাজউদ্দীন। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, পার্টির মধ্যে তখন টানাপড়েন চলছে প্রেসিডেন্ট কে হবেন? ওই সময়ে আমার চেনাশোনা এক কাউন্সিলরের সঙ্গে আলাপকালে আমি তাকে বলেছিলাম, ‘শেখ হাসিনা দিল্লিতে আছেন, তাকে এনে প্রেসিডেন্ট করে দেন।’ কাকতালীয়ভাবে হলেও শেষ পর্যন্ত আমার ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটে পার্টির সিদ্ধান্তে। পার্টির পক্ষ থেকে শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতা দিল্লিতে গিয়ে তাকে নিয়ে আসেন। স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বহু চড়াই-উতরাই, বহু বাঁক পার হয়ে দেশ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার তেজস্ব নেতৃত্বে এখন অর্থনৈতিক সূচকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বলতে হয়, নৈতিকতা ও মানবিকতার সূচকে আমরা শূন্য কোটার দিকে ধাবিত হচ্ছি। জলবায়ু দূষণে ও দুর্নীতিতে আমরা এখন সবার শীর্ষে। প্রবৃদ্ধি দিয়ে কী হবে যদি বিশুদ্ধ বায়ু সেবন ও বিশুদ্ধ জল পান করা জাতির ভাগ্যে না জোটে। প্রবৃদ্ধির ফায়দা সবাই ভাগ করে না পেয়ে শুধু কিছু লোকের দেশ-বিদেশের ব্যাংকে জমা হতে থাকে। ব্যাংকে টাকা থাকে কিন্তু আমাদের দেশে লোকের বাড়িতে টাকার গুদাম থাকে তাও দেখলাম। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবলে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের মনকে দুর্নীতি মুক্ত করা যাবে না। সে জন্য প্রয়োজন নৈতিকতা ও মানবিকতার চর্চা যা এখন সমাজ থেকে উঠে গেছে বললেই চলে। এক সময়ে ধর্ম ও দর্শন থেকে আমরা এ শিক্ষা পেতাম। ধর্ম এখন রাজনৈতিক ও আর্থিক স্বার্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর দর্শন জ্ঞান লাভের মাধ্যম হিসেবে পরিত্যক্ত। হাজারে একজনের বেশি দর্শনের ছাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। দুর্নীতি আক্রান্ত পিতা-মাতা দুর্নীতিমুক্ত সন্তান-সন্ততি আশা করতে পারেন না। দুর্নীতি আক্রান্ত সমাজপতিরা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে পারেন না। তাই প্রয়োজন ডিগ্রি অর্জনের প্রচলিত পেশাদারি শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতা ও মানবিকতা শিক্ষাদান। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। প্রাথমিক থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত সব স্তরের পাঠ্যক্রমে এ শিক্ষার প্রচলন করলে অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিছুটা হলেও দুর্নীতির ভাইরাস থেকে রক্ষা পাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন, তিনি যেন এ প্রস্তাবটা বিবেচনায় নেন। বঙ্গবন্ধুর শতবার্ষিকীর জন্মদিনে আমরা যেন বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া গুণাবলি যেমন আল্লাহপ্রীতি, সততা, একনিষ্ঠতা, নৈতিকতা, ত্যাগ, ভালোবাসা, দেশপ্রেম- এসবে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক আদর্শিক বাংলাদেশ গড়ার পথে সদর্পে এগিয়ে চলি। আমাদের ব্যর্থতার কারণে স্বপ্ন যেন সবার জন্য দুঃস্বপ্নে পরিণত না হয়। শুধু আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা ও মেকি ভালোবাসা দিয়ে দেশ গঠনে ও স্বপ্ন পূরণে কোনো কাজে আসবে না। বঙ্গবন্ধুকে একজন বিশাল মনের মানবতাবাদী ও নীতিতে অটল নেতা হিসেবে পেয়েছি। তাই তাঁকে আমি মানববন্ধু হিসেবেই দেখি এবং তাঁকে আমি এখন থেকে এ নামেই স্মরণ করব। মানববন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আমরা যেন তোমার মহৎ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হই।

                লেখক : বাংলাদেশ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর