বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কভিড-১৯ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিদেশে প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশির মৃত্যু ঘটছে। সৌদি আরবে করোনায় মৃতদের ২০ শতাংশ বাংলাদেশি নাগরিক। গত ২৪ ঘণ্টায় কানাডায় মারা গেছেন আরও দুই বাংলাদেশি। এর আগেও দেশটিতে দুই বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। এ নিয়ে বিদেশে এই পর্যন্ত বাংলাদেশির মৃত্যু সংখ্যা ১৭৭। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ১০৫ জন, যুক্তরাজ্যে ৪৩ জন, সৌদি আরবে ১১ জন, কানাডায় ৪ জন এবং ইতালিতে ৬ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া কাতারে ৩ এবং ওমান, স্পেন, সুইডেন, লিবিয়া ও গাম্বিয়ায় একজন করে বাংলাদেশি মারা গেছেন।
কানাডায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আইটি প্রকৌশলী জামাল আলী (৪৫) ও আশরাফুল ইসলাম ওমর (৪২)। এ নিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিকের মৃত্যু হলো। ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় টরেন্টোর দুটি হাসপাতালে তারা মারা যান।
এদিকে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে মরুর দেশ সৌদি আরবে। প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। প্রায় প্রতিদিনই নতুন করে রেকর্ডসংখ্যক আক্রান্তের খবর জানাচ্ছে সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৬৫১ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৬৮৫ জন। আর মৃত্যুবরণ করেছেন ৪৭ জন।দূতাবাস এবং কনস্যুলেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সৌদিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১১ জন বাংলাদেশি প্রবাসী। যা মোট মৃত্যুহারের ২০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে মদিনায় ৭ জন এবং তাদের চারজনই চট্টগ্রামের।
বাংলাদেশ দূতাবাস রিয়াদ এবং বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল জেদ্দা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া বাংলাদেশিরা হলেন- সাভারের কোরবান (মদিনা), নড়াইলের ডাক্তার আফাক হোসেন মোল্লা (মদিনা), চট্টগ্রামের মোহাম্মদ হাসান (মদিনা), চট্টগ্রামের মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন (মদিনা), ভোলার মোহাম্মদ হোসেন (রিয়াদ), পাবনার আবদুল মোতালেব (রিয়াদ), মানিকগঞ্জের মান্নান মিয়া (জেদ্দা), চট্টগ্রামের মোহাম্মদ রহিম উল্লাহ (মদিনা), নরসিংদীর খোকা মিয়া (মদিনা), চট্টগ্রামের নাসির উদ্দিন (মদিনা) এবং আজিবর (মদিনা)।
সৌদি সরকার করোনার বিস্তার রোধ করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। পাশাপাশি নাগরিক এবং বিদেশিদের সচেতন করতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক তথ্য দিয়ে সেলফোনে ২ বিলিয়নের বেশি খুদে বার্তা পাঠিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশিদের সচেতন করতে সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রচারপত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এ ছাড়াও সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহর দেওয়া একটি বাংলা বক্তব্য প্রচারের পরিকল্পনা নিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এত কিছুর পরও কিছু কিছু এলাকার বাংলাদেশিরা এখনো বেপরোয়া। ২৪ ঘণ্টা কারফিউ চলমান থাকার পরও তারা অকারণে জমায়েত হচ্ছেন। বাংলাদেশিদের স্থানীয় আইন মেনে ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে মিশনগুলো।
বড় বড় শপিং মলের সামনে করোনা থেকে বাঁচার বিভিন্ন উপায় সংবলিত রোল আপ স্ট্যান্ড লাগানো হয়েছে।
বাংলাদেশিরা খুব বেশি আইন মানছেন না এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। তারা বলছেন কিছু কিছু এলাকায় কিছু অতিউৎসাহী বাংলাদেশিদের কারণে সৌদি আরবে বসবাসরত সব বাংলাদেশি বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। সৌদি আরবে কর্মরত বেশির ভাগ বাংলাদেশি যেহেতু নিম্নআয়ের এবং গণবসতিতে বাস করেন, সেহেতু এখনই যদি সতর্ক না হয় তাহলে সামনে ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছে বলেও মত দেন অনেকে।
ফয়সাল আহমেদ নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘স্বাভাবিক কমনসেন্স থেকে আশঙ্কা করছিলাম সৌদি আরবের বিভিন্ন কোম্পানির লেবার ক্যাম্পে ভাইরাস বিস্তার লাভ করলে কী বিপর্যয় হতে পারে। শুক্রবারের খবর অনুযায়ী মদিনা শহরের বিভিন্ন লেবার ক্যাম্পে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, পূর্বাঞ্চলেও নাম করা কয়েকটি বড় কোম্পানির লেবার ক্যাম্প রয়েছে, যেখানে আছে হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক। রাব্বুল আলামিন নিরাপদ রাখুন। প্রত্যেকেই নিজ সহকর্মীর মোবাইল নম্বর, পাসপোর্ট, আকামা কপি নিজের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে রাখলে ভালো হবে।’
মো. ফজলুল হক শেখ লিখেছেন, ‘সৌদিতে কারপিউর (কারফিউ) মধ্যেও হারা বাঙালি অধ্যসিত (অধ্যুষিত) এলাকায় একটি জংলি ডিস্ট্রিকের মারামারি দেখে মনে হল কতটা বর্ভর (বর্বর) এরা, জাতি হিসেবে দায়বার (দায়ভার) আমাদের কাদেও (কাঁধেও)।’
এ ছাড়াও অনেক বাংলাদেশি ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করে বাংলাদেশিদের আইন না মানার বিষয়টি তুলে ধরে দূতাবাসের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বাংলাদেশ দূতাবাস রিয়াদের শ্রম কল্যাণ কাউন্সিলর মো. মেহেদী হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দূতাবাসের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হতে বলা হচ্ছে। খাদ্য সংকটে থাকা প্রবাসীদের দূতাবাসের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। ৫-৬ হাজার বাংলাদেশির কাছ থেকে মেসেজ পাওয়া গেছে। তবে এখন যেহেতু ২৪ ঘণ্টা কারফিউ সে কারণে আমরা কোথাও মুভ করতে পারছি না। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। সহায়তা বিতরণের জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। তারা সম্মতি দিলে আমরা সাহায্যপ্রার্থী প্রবাসীদের তথ্য ও সামগ্রী দেব। তারা ঘরে ঘরে সেটা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। যোগ করেন এই কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ উইং এর একটি টোল ফ্রি হটলাইন নম্বর (৮০০১০০০১২৫) প্রবাসীদের সেবায় ২৪ ঘণ্টা চালু রাখা হয়েছে। প্রবাসীরা চাইলে এখানে কল করে যে কোনো ধরনের পরামর্শ নিতে পারবেন এজন্য ফোনে কোনো টাকা কাটবে না।