রবিবার, ২৬ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

সাইকোডেলিক মাদক ঠেকানোই বড় চ্যালেঞ্জ

আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস আজ

আলী আজম

কয়েক বছর ধরে দেশের মাদকের বাজার দখল করে আছে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা। চাহিদা বাড়ায় এসব মাদকের চালান একদিকে যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে নিত্যনতুন মাদকের আবির্ভাব ঘটছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আসা ‘সাইকোডেলিক’ মাদক- লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাই-ইথালামাইড (এলএসডি), ডায় মিথাইল ট্রিপ্টামিন (ডিএমটি) ও ম্যাজিক মাশরুম (সিলোসাইবিন)। এ ছাড়া নিয়মিত উদ্ধার হচ্ছে ক্রিস্টাল মেথ আইস, নিউ সাইকো-অ্যাকটিভ সাবস্টেনসেস (এনপিএস) বা খাত, এস্কাফ সিরাপ ও ডিওবির মতো মাদক। এর সঙ্গে জড়িতরা গ্রেফতার হচ্ছে, জেলহাজতে যাচ্ছে। কিন্তু মাদকের ব্যবহার কোনোভাবেই কমছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন আবির্ভাব ঘটা মাদকগুলোর মধ্যে সাইকোডেলিক মাদকগুলোর চালান ঠেকানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এসব মাদক শনাক্তের প্রযুক্তি দেশে নেই। এমনকি মাদকগুলোর বিষয়ে পরিচিত নন স্বয়ং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ফলে ধনাঢ্য ঘরের সন্তানরা এসব মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। যদি দেশের বাজারে এসব মাদকের চালান বাড়তে থাকে তাহলে দাম কমে সব শ্রেণির মাদকাসক্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব ধরনের মাদক নির্মূলে চাহিদা হ্রাস করতে সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও বলছেন, শুধু ধরপাকড়ের মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এদিকে র‌্যাবের ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগান সামনে রেখে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান আবারও চালু হচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে ‘কমপ্রিহেন্সিভ অ্যাকশন প্ল্যান’ বা সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। শুধু ধরপাকড় নয়, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও সচেতনতা বাড়িয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কর্মশালা করার মাধ্যমে এ কর্মপরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসি কর্মকর্তারা।

ডিএনসির তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সংস্থাটি ২৫ হাজার ৬৫০টি অভিযানে ৬ হাজার মামলা দায়ের করে ৬ হাজার ৫২৫ জনকে গ্রেফতার করে। এ সময়ে ১৩ লাখ ৩৫ হাজার ৭৪৪ পিস ইয়াবা, ১ হাজার ৯২০ কেজি গাঁজা, ৯ হাজার ১৬৯ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করেছে। আর চলতি বছরের দুই মাসে সব সংস্থা (ডিএনসি, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড) জব্দ করেছে ৬২ লাখ ৫৫ হাজার ২৬৮ পিস ইয়াবা। সব সংস্থা মিলে ২০২১ সালে প্রায় ৩৭ কেজি এবং চলতি বছর মে মাস পর্যন্ত ৬৮ কেজি আইস জব্দ করেছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিয়মিত ধরা পড়ছে পশ্চিমা দেশগুলোর জনপ্রিয় সাইকোডেলিক মাদক এলএসডি, ম্যাজিক মাশরুম ও ডিএমটি। এর মধ্যে এলএসডির ২০টির বেশি চালান জব্দ করা হয়েছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণের যুদ্ধ সামাজিক যুদ্ধ হতে হবে। কারণ শুধু অভিযান পরিচালনা করে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার লোকজনকে এগিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন কৌশলে সীমান্ত, আকাশপথ ও বিশাল সমুদ্র এলাকা দিয়ে মাদকের চালান আসছে। যে রুটেই মাদক আসুক আমরা কাজ করছি। মাদক কারবারিদের গ্রেফতার করছি, মাদক জব্দ করছি। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীরা আবার রুট পরিবর্তন করে মাদক আনছে। মূলত মাদকের ডিমান্ড কমাতে হবে। এগুলো তখনই নির্মূল হবে, যখন আর চাহিদা থাকবে না।’

ডিএনসির পরিচালক (অপারেশনস) কুসুম দেওয়ান বলেন, “ভৌগোলিক কারণে মাদকের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল, গোল্ডেন ওয়েজ, গোল্ডেন ভিলেজ ও গোল্ডেন ক্রিসেন্ট এলাকাগুলোর জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশ। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সচেতনতার বিকল্প নেই। এ জন্য ‘সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা’ নামে নতুন কর্মসূচি শুরু করা হয়েছে। আশা করছি এ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণে আসবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, বাংলাদেশে যারা মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন, তাদের দায়িত্বে অবহেলা, অত্যাধুনিক মাদক শনাক্তের প্রযুক্তি না থাকা, মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশসহ নানারকম ফাঁকি থাকায় কাজের কাজ হচ্ছে না। পাশাপাশি মাদকের সহজলভ্যের কারণে দিন দিন চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিকার নেই। উল্টো অনলাইনে অর্ডার দিলে ঘরে বসে মাদক পাওয়া যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দিবসে সীমাবদ্ধ না থেকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এদিকে অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশে আজ পালিত হতে যাচ্ছে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘মাদক সেবন রোধ করি, সুস্থ সুন্দর জীবন গড়ি’। এ উপলক্ষে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ডিএনসি। আজ সকালে রাজধানীর রমনা পার্কের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে মাদকবিরোধী মানববন্ধন ও র‌্যালি করা হবে। পাশাপাশি ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

সর্বশেষ খবর