১১ এপ্রিল, ২০১৬ ১১:৫৬
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য, সুলতান সুলেমান (পর্ব-৬)

রণক ইকরাম


অটোমান সূর্য, সুলতান সুলেমান (পর্ব-৬)

‘সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট’ খ্যাত সুলতান সুলেমান পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা শাসক ছিলেন। ক্ষমতার টানাপড়েনে ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, ভাই-সন্তান হত্যা, দাসপ্রথা আর হেরেমের নানা পরিক্রমা ছাপিয়ে এগিয়ে গেছে সুলেমানের শাসনকাল। তার আমলেই আলেকজান্দ্রা নামের এক সাধারণ দাসী হয়ে ওঠেন সুলেমানের স্ত্রী ও সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সম্প্রতি নতুন করে আলোচনায় আসা সুলেমানকে নিয়ে ইতিহাস আশ্রয়ী এ উপন্যাস। অনেক পাঠকই গল্পের সোর্স জানতে চেয়েছেন। এই উপন্যাসের সরাসরি কোনো উৎস নেই। তবে তথ্য উপাত্তের মূল উৎস অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস বিষয়ক নানা বইপত্র। মূল চরিত্র আর গল্প ঠিক রেখে লেখক তার কল্পনায় তুলে এনেছেন সেই সময়টুকু। টিভি সিরিজ মুহতাশিম ইউজিয়েলের সঙ্গে আমাদের যেমন কোনো বিরোধ নেই, তেমনি এর অনুকরণেরও প্রশ্নই ওঠে না। প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ষষ্ঠ পর্ব।

ছকে বাঁধা দিনের পিঠে চেপে নেমে আসে রাত। বরাবরের নিয়মে রাত ভোর হয়। মাহিদেভরানের জীবনে বাড়ে কেবল উত্কণ্ঠা। মাস ছয়েক আগে অসুস্থ ছিলেন যুবরাজের মাতা আয়শা হাফসা সুলতান। এবার অনেকদিন হলো শয্যাশায়ী যুবরাজের পিতা সুলতান সেলিম খান। সুলতানের অসুস্থতার খবর চারদিকে চাউর হওয়া মাত্র সবার আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছেন যুবরাজ সুলেমান। সবার মুখে একটাই কথা সুলেমানের সুলতান হওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। এই ব্যাপারটাই বেশি ভাবিয়ে তুলছে মাহিদেভরানকে। তাই রাতের বেলা সুলেমানের পাশে শুয়েও দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না তিনি।

মাহিদেভরানের চিন্তা ভরা মুখটা নজর এড়ালো না সুলেমানের।

‘মাহিদেভরান কোনো সমস্যা?’

‘জি না সুলেমান।’

মাহিদেভরান এড়িয়ে গেলেন। সুলেমান বাঁ হাতটা উঠিয়ে মাহিদেভরানের কপালে বুলাতে রাখলেন। তারপর স্ত্রীর দিকে খানিকটা ঝুঁকে কপালে একটা চুমু খেলেন। মাহিদেভরানের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠল। সেদিকে খেয়াল নেই সুলেমানের। তিনি আরেকবার স্ত্রীর কপালে হাত রাখলেন।

‘তুমি কী কোনো কারণে চিন্তিত, মাহিদেভরান?’

মাহিদেভরান সুলেমানের বুকে মাথা রেখেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

যুবরাজ তখন স্ত্রীর পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। এরপর আরেকবার জিজ্ঞেস করলেন—

‘কী হয়েছে আমায় বলবে তো?’

‘সবাই বলছে শিগগিরই আপনি সুলতান হতে যাচ্ছেন। এই কথা শোনার পর আমি যতটা না খুশি হয়েছি, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত বোধ করছি।’

‘কেন, মাহিদেভরান।’

স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন সুলেমান।

‘এসব রক্তারক্তি, ক্ষমতার লড়াই আমার ভাল্লাগে না।’

‘কিছু করার নেই মাহি। এটাই নিয়তি। এমন মানুষের ঘরে এসেছ এর কোনো বিকল্প নেই। এটা মেনে নিয়েই বাঁচতে হবে।’

‘কিন্তু সুলেমান...আমি আপনাকে হারাতে চাই না।’

‘ভয়ের কিছু নেই। আমার কিচ্ছু হবে না। সবার দোয়া আর সমর্থনে আমি ঠিক সফল হব ইনশাআল্লাহ। এখন তবে ঘুমোও।’

বলেই স্ত্রীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন সুলেমান। মাহিদেভরান কিছু বললেন না। স্বামীর বুকে নিরাপদ আশ্রয়ে মুখ বুজে রইলেন কেবল। মনের ভিতর তখনো দ্বিধার জঞ্জাল। এভাবে কতদিন। মানিসার রাতও তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। ঘুমিয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগল না।

সুলতান প্রথম সেলিমের অসুস্থতা গোটা কনস্টান্টিনোপলে অদ্ভুত এক ধরনের পরিবেশ তৈরি করেছে। মিসরে সফল অভিযানের কারণে সবাই খুব আনন্দে ছিল। এর মধ্যে নতুন আনন্দের আবহ এনে দিয়েছিল সুলতানের হাঙ্গেরি অভিযানের ঘোষণা। সৈন্য তো বটেই সাধারণ তুর্কিরাও হাঙ্গেরি অভিযানে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায়। সব প্রস্তুতি যখন প্রায় চূড়ান্ত তখনই বাদ সাধে সুলতানের অসুস্থতা। যাবতীয় উত্তেজনায় পানি ঢেলে দেওয়া এই অসুস্থতা তিনি মাস ধরেই কনস্টান্টিনোপলবাসীকে নির্জীব করে রেখেছে। এই নির্জীবতার কেন্দ্রে স্বয়ং সুলতান সেলিম। বিছানায় শুয়ে তিনি কাতরাচ্ছেন আর প্রলাপ বকছেন। তাকে থামানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন আয়শা হাফসা সুলতান।

‘সুলতান, আপনি একটু স্থির হোন। এত উতলা হবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘কিচ্ছু ঠিক হবে না। তুমি এখনই সুলেমানকে খবর পাঠাও। আমি তাকে সুলতান ঘোষণা করে যেতে চাই।’

‘না... সুলতান। আপনি যতদিন আছেন ততদিন সুলেমানের জন্য যুবরাজের পরিচয়টাই অনেক বড়। আর দেখবেন দ্রুতই আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। এত উতলা হওয়ার কোনো কারণ নেই।’

আয়শা হাফসা সুলতান সেলিমকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। সম্ভবত পিপাসা পেয়েছে সুলতানের। ইশারা বুঝতেই আয়শা নিজেই কাঁসার গ্লাসে করে পানি নিয়ে নিলেন সুলতানের জন্য। সুলতানের তখন উঠে বসার মতো শক্তিও নেই। ব্যক্তিগত সহকারী মনজিলার সহযোগিতা নিয়ে সুলতানকে টেনে একটু বসালেন। এরপর নিজের হাতেই পানি পান করিয়ে দিলেন সুলতানকে।

শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার বলতে শুরু করলেন সুলতান সেলিম খান।

‘আমি আমার পিতার সঙ্গে অন্যায় করেছি। তাকে সিংহাসনচ্যুত হতে বাধ্য করেছি। আল্লাহ আমাকে মাফ করবেন না। আমি আমার ছেলের সঙ্গে অন্যায় করতে চাই না। আমি চাই আমার জীবদ্দশাতেই সে অটোমান সাম্রাজ্যের সিংহাসন অলঙ্কৃত করুক।’

‘সুলতান সব হবে। আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন। হেকিম আপনাকে একদম উত্তেজিত হতে মানা করেছে। আপনি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন।’

গত কদিন ধরে এই কথাটা আয়শা হাফসাকে অসংখ্যবার বলতে হয়েছে। সুলতান সেলিম বারবার এসব প্রলাপ বকেন আর আয়শা সেটাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালান।

স্ত্রীর কথা শুনে ঘুমানোর জন্য দু চোখ বুজলেন সুলতান প্রথম সেলিম খান। কিন্তু কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই স্ত্রীর হাত চেপে বললেন,

‘আয়শা.. আমি কী খুব খারাপ মানুষ?’

‘এ কথা কেন বলছেন আপনি সুলতান। আপনি ইতিহাস সেরা অটোমান সুলতানদের একজন। আপনি ইসলামের মহান খলিফা। এসব কথা আপনার মুখে একদম শোভা পায় না।’

স্ত্রী প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করে সেলিম খানকে।

সুলতান সেলিম কোনো জবাব দিলেন না। দু চোখ বুজে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।

আয়শা হাফসাও সেখান থেকে সরে পড়লেন। সুলতানের অবস্থা নিয়ে হেকিমের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

সারা খাতুনের সঙ্গে গল্প করছেন মাহিদেভরান। যুবরাজ সুলেমান যখন প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকেন তখন মুস্তফা আর সারা খাতুনই তার আসল সঙ্গী হয়ে ওঠে। একথা ওকথার ফাঁকে সুলতানের প্রথম স্ত্রীর প্রসঙ্গ তুললেন সারা খাতুন। শোনার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ গরম করে সারা খাতুনের দিকে তাকালেন মাহিদেভরান।

‘আমার কোনো ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন মালিকা। এমনি জানতে চাইলাম। অনেকের কাছ থেকে গুলফাম সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি তো তাই জিজ্ঞেস করলাম।’

মাহিদেভরান একটু চুপ থাকলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিলেন যেন। এরপর বললেন,

‘কী শুনেছ তুমি?’

‘এইতো, এটাই যে যুবরাজ সুলেমান নাকি তাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন?’

‘এটুকুই জানো? আর কিছু শোনোনি?’

‘নাহ। আর তেমন কিছু শুনিনি। তবে গুলফাম খাতুন নাকি বেশ ভালো মানুষ ছিলেন। আসলে এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানি নাতো, তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি আর কি। ভুল হলে আমাকে ক্ষমা করবেন মালিকা।’

‘না। ভুল হয়নি। তবে ভুল কিছু কিংবা অসম্পূর্ণ কিছু জানাটা ঠিক নয়। জানলে পুরোটাই জানতে হবে। অর্ধেক জানাটা ঠিক নয়।’

একটু বিরক্তি আর খানিক ক্রোধ নিয়ে সারা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বললেন মাহিদেভরান। জবাবে মাথা নুইয়ে মাহিদেভরানকে কুর্নিশ করল সারা।

‘জি মালিকা। আপনাকে ধন্যবাদ।’

‘শোনো গুলফাম খাতুন ভালো মানুষ ছিলেন নিঃসন্দেহে। তিনি বেশ সুন্দরীও ছিলেন। তার সম্পর্কে আমিও যে খুব বেশি জানি তা নয়। সুলেমানের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলা নিষেধ।’

বলে সারার দিকে একটু তাকালেন মাহি। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন,

‘এরপরও যতটুকু শুনেছি তিনি সুলেমানের সন্তানের মা-ও হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের গাফিলতির কারণে শাহজাদাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি। এতে সুলেমান খুব রাগ করেছিলেন। এরপরও তিনি গুলফামকে ক্ষমা করে দেন। অন্যদিকে গুলফাম কিছুটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে ওঠেন। তিনি আল্লাহর প্রার্থনা ও সমাজসেবামূলক নানা কাজের সঙ্গে নিজেকে সব সময় জড়িয়ে রাখতেন। এর মধ্যেই গুলফাম একটি ব্যয়বহুল মসজিদ তৈরির কাজে হাত দেন। কিন্তু এমন একটি মসজিদ তৈরির জন্য যে পরিমাণ অর্থের দরকার ছিল, তা গুলফামের কাছে ছিল না।’

‘এরপর?’

সারা খাতুনের কণ্ঠে প্রবল কৌতূহল।

‘এরপরও গুলফাম দমে যাননি। তিনি ঠিক মসজিদ তৈরি করতে থাকলেন। অনেকের কাছ থেকে অর্থ ধার করে মসজিদের কাজ এগোতে থাকলেন। এ সময় হারেমের কয়েকজন মেয়ের কাছ থেকেও অর্থ ধার করেন গুলফাম। সানিলা নামের একজন নারী ছিলেন হারেমে। তার কাছে অর্থ ধার চাইতে গেলে সে অদ্ভুত এক শর্ত জুড়ে দেয়।’

‘শর্ত? কী শর্ত মালিকা?’

দারুণ আগ্রহী হয়ে ওঠেছে সারা খাতুন।

‘শর্ত হলো সানিলা গুলফামকে অর্থ দেবেন ঠিকই, তবে বিনিময়ে সুলেমানের কাছে তাকে যেতে দিতে হবে।’

‘এটা কীভাবে সম্ভব?’

‘সেটাইতো? সুলেমানের পছন্দ বা অনুমতি ছাড়া তার কাছে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। সানিলা গুলফামকে শর্ত দিল সুলেমান যখন তাকে ডাকবেন তখন যেন গুলফামের বদলে সানিলাকে পাঠানো হয়। গুলফাম প্রথমে রাজি হননি। পরদিন কী ভেবে রাজি হয়ে গেলেন তিনি। এর মধ্যেই একদিন গুলফামের ডাক পড়ে সুলেমানের ঘরে। গুলফাম শর্ত মতে নিজে না গিয়ে পাঠালেন সানিলাকে। তাকে দেখা মাত্রই প্রচণ্ড রেগে উঠলেন সুলেমান। তার আদেশ অমান্য করার জন্য তিনি গুলফামের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেন। তবে অনেকে বলে যে গুলফাম নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন। আসল সত্যটা কেবল স্বয়ং সুলতানই বলতে পারেন।’

‘আহ্ হা’

সারা খাতুনের কণ্ঠে দারুণ বিস্ময় আর সহমর্মিতা।

মাহিদেভরানের গোসলের সময় হয়ে গেছে। সারা খাতুন সেটা মনে করিয়ে দিতেই মাহি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কাপড় গুছিয়ে পা বাড়ালেন গোসলখানার দিকে।

হেকিম হালিমের নেসা আর মালিদ আগা দাঁড়িয়ে আয়শা হাফসা সুলতানের সামনে। আরেকপাশে দাঁড়িয়ে আছেন সুলতানার ব্যক্তিগত সহকারী মনজিলা। সবার চেহারায় উদ্বেগের ছাপ।

‘হেকিম আমায় বলবেন, আসলে ঠিক কী হয়েছে সুলতানের?’

হালিমের নেসার দিকে তাকালেন মালিদ আগা। ইশারায় জবাব দেওয়ার কথা বললেন হালিমের নেসা।

‘সুলতানা, আমার অপরাধ মার্জনা করবেন। সুলতানের অসুখটা ঠিক ভালো নয়। ভয়ানক রোগ।

এই রোগ সারার কোনো উপায় নেই।’

‘মানে? কী করে হলো এই রোগ?’

মালিদ আগার কথায় ক্রোধের সঙ্গে বললেন আয়শা হাফসা।

জবাবে আরেকবার মুখ খুললেন মালিদ আগা।

‘সুলতানা কদিন আগেই সুলতান মিসর অভিযানে গিয়েছিলেন। এই অভিযান চলাকালে তিনি দীর্ঘদিন ঘোড়ার পিঠে চড়েন। সেখান থেকেই পশুবাহিত একটা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। এই রোগের কোনো চিকিৎসা আমাদের কাছে নেই।’

এবার আর কিছু বললেন না সুলতানা। চুপ থাকলেন বেশ কিছুক্ষণ। ইশারায় হেকিম দুজনকে চলে যেতে বললেন। মনজিলা সামনে এসে দাঁড়ালেন সুলতানার। সুলতানার দু চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মনজিলা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

‘সুলতানা আপনি ভেঙে পড়বেন না। আপনি যদি ভেঙে পড়েন, তাহলে এই সময়ে সুলতানকে কে সামলাবে?’

মনজিলার কথা শোনে দুই চোখের পানি মুছলেন আয়শা হাফসা সুলতান। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। এ ছাড়া আর কী উপায় আছে?

‘সুলেমানকে কী এখননি ডাকব?’

মনজিলার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন আয়শা।

‘অপরাধ নেবেন না সুলতানা। যুবরাজ নিশ্চয়ই মানিসায় ব্যস্ত আছেন। কদিন আগেই তো সুলতানকে দেখে গেলেন। এই মুহূর্তে উনাকে ডাকলে সুলতান হয়তো আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তাই যুবরাজকে বোধ হয় এখন না ডাকলেই ভালো হবে। সবকিছু আপনাকেই সামলাতে হবে।’

‘হুম। ঠিক বলেছ।’

দীর্ঘশ্বাসে ঘরের বাতাস ভারী করে সায় দিলেন সুলতানা।

সুলতানের অসুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন পিরি মেহমুদ পাশাসহ অটোমান সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। সবাই সুলতানার দর্শনপ্রার্থী। সুলতানের অবর্তমানে অটোমান সাম্রাজ্যের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তাদের ঘাড়েই বর্তায়। আর তারা সেটি করতে চান আয়শা হাফসা সুলতানার নির্দেশেই। অল্পক্ষণের জন্য সবার সামনে উদয় হলেন আয়শা। সংক্ষেপে সব করণীয় জানিয়ে দিলেন। সুলতানের জন্য সবার কাছে দোয়া চাইলেন। পিরি মেহমুদ পাশা সুলেমানের আগমনের বিষয়ে জানতে চাইলেন। কিন্তু আয়শা দৃঢ়ভাবে জবাব দিলেন এখনো যুবরাজের আসার সময় হয়নি। সভাসদদের প্রত্যেকেই সুলতানের সুস্থতা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করে দোয়া আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। এ বিষয়ে সব ব্যবস্থা নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন সুলতানা।

সুলতানের শরীরের আসল অবস্থাটা তিনি সবার সামনে প্রকাশ করতে চাননি। কারণ এতে করে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আয়শার পক্ষে কঠিন হবে। তাই মুখে দৃঢ়তা দেখালেও ভিতরে ভিতরে তিনি ঠিকই পুড়ছিলেন। সেই সঙ্গে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সুলতানকে বিদায় জানানোর। অটোমানদের দীর্ঘদিনের ইতিহাস আয়শা হাফসা সুলতানার জানা। এখানে থেকে শিখেছেন প্রাসাদ ষড়যন্ত্র কী। সুলতান প্রথম সেলিমের স্ত্রী হিসেবে দেখেছেন রাজ্য পরিচালনায় কোন সময়ে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে সুলতান সেলিম খানের কক্ষে পৌঁছে গেলেন আয়শা। স্ত্রীর আগমন টের পেয়ে চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন সুলতান। আয়শা এগিয়ে গিয়ে স্বামীর পাশে বসে পড়লেন।

‘এখন কেমন লাগছে সুলতান?’

শুকনো হাসি হেসে বললেন আয়শা।

‘ভালো না।’

‘সব ঠিক হয়ে যাবে সুলতান। ভয়ের কিছু নেই। হেকিম বলেছে একটু বিশ্রাম নিলে আর ওষুধ খেলেই আপনি ঠিক হয়ে যাবেন।’

আয়শার কথা শুনে হাসলেন সুলতান সেলিম খান। বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে স্ত্রীর হাতটা ধরে নিজের বুকের ওপর রাখলেন। এরপর বললেন,

‘আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছ বেগম? আমি সব বুঝতে পারি। আমি যুদ্ধের ময়দানে কত মৃত্যু দেখেছি। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও কখনো ভয় পাইনি। আর এখন নিজের ঘরে নিজের রাজ্যে স্ত্রীর ভালোবাসার ছায়াতলে থেকেও ভয় কাটছে না আমার। এর মানে কী জানো?’

‘মানে জানি না। জানতেও চাই না। আপনি দয়া করে একটু চুপ থাকুন ঘুমানোর চেষ্টা করুন সুলতান।’

‘এখন আর স্বাভাবিক ঘুম আসবে না আমার। আমার জন্য অপেক্ষা করছে অনন্ত ঘুম। চোখ বুজলেই সব শেষ। আমি আমার খুব কাছাকাছি মৃত্যু দেখতে পাচ্ছি।’

দাঁত বের করে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন সুলতান সেলিম খান। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনিই অটোমান সাম্রাজ্যের অধিকর্তা, সবার মনে ত্রাস জাগানিয়া সুলতান। দু চোখের তীব্র শূন্যতা জানান দিচ্ছে সুলতান তার জীবন সায়াহ্নে চলে এসেছেন।

‘এভাবে বলবেন না সুলতান। আমি নিতে পারছি না। আপনি দয়া করে চুপ থাকুন।’

কথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেললেন আয়শা হাফসা। স্ত্রীর দিকে করুণ চোখে চেয়ে আরকেবার হাসলেন সেলিম খান।

‘কেঁদ না, আয়শা। নিয়তির লিখন কে মুছতে পারে বল? আমার ডাক চলে এসেছে আমাকে যেতেই হবে। কেউ আটকাতে পারবে না।’

‘সুলতান।’

স্বামীর বুকে হাত চেপে ধরে অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে উঠলেন আয়শা।

‘আয়শা স্থির হও। আমার তোমাকে কিছু বলার আছে। আমার হাতে একদম সময় নেই।’

‘এসব কী বলছেন সুলতান?’

‘শোনো আমি তোমার কাছে কোনো অন্যায় করে থাকলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। এই সাম্রাজ্য আমার স্বপ্ন। তুমি তা দেখে রেখ। আমাদের সন্তান এই অটোমান সাম্রাজ্যের সূর্য সুলেমানকে তুমি তার করণীয় বুঝিয়ে দিও। আমিতো তাকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে পারলাম না। সব দায়িত্ব তোমার। আল্লাহ তোমাদের ভালো রাখুন।’

বলেই কয়েক সেকেন্ড স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন সুলতান। এরপর তার চোখ জোড়া স্থির হয়ে গেল। আয়শা হাফসা সুলতান যেন টের পেলেন কিছু একটা। চিৎকার করে উঠলেন তিনি মনজিলা... হেকিমকে ডাকো...মনজিলা!


চলবে... পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার


বিডি-প্রতিদিন/১১ এপ্রিল, ২০১৬/মাহবুব

 

সর্বশেষ খবর