১০ অক্টোবর, ২০১৮ ১৬:৪৮

মুক্তির দিশারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম

সুলতান মাহমুদ শরীফ

মুক্তির দিশারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম

স্বাধীন বাংলার অন্যতম রূপকার বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রাণপুরুষদের অন্যতম। বাংলাদেশ সৃষ্টির দীর্ঘ সংগ্রামে তার অবদান অপরিসীম। শিক্ষা জীবন শেষ করে প্রথমে সরকারী চাকরি নিয়ে তা ছেড়ে দিয়ে বাংলার দুঃখী মানুষের মুক্তির আন্দোলনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত প্রাণ কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন যুবক বয়সে। ময়মনসিংহে ওকালতি ও জনসেবার কাজে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে তার উপলব্ধি হয়েছিল যে, বাংলার মানুষকে পাকিস্তানিদের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে।  হাজার বছর ধরে বাংলার মানুষ যে অভাব ও দুরবস্থায় আছে এ থেকে মুক্তি না হলে শান্তি, স্বস্তি আর জীবন জীবিকা অর্জনের অভাব থেকেই যাবে তাদের।  

তাই দৃঢ়চেতা এই মানুষটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সম্পৃক্ত করে নেন। তার জীবনীতেই লেখা আছে, মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁরই নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার মূল দায়িত্ব তার উপরই বর্তায়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ১০ এপ্রিল একাত্তরে মুজিবনগর থেকে প্রচারিত হয় তাতে উল্লেখ করা হয় যে, "বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মানিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি  উদাত্ত আহবান জানান"।       

সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের জীবনীতে আরও লেখা আছে, "২৫ মার্চের রাতের পরে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম, তাই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠণের ঘোষণাপত্রে আমাদের একটু বিলম্ব হয়েছিল। আমরা যে ৫ জন শেখ সাহেবের পাশে ছিলাম এবং যাদের কাছে কথিত, লিখিত, অলিখিত সর্বপ্রকার দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু দিয়ে গিয়েছিলেন ১৩ এপ্রিল তারিখে (১৯৭১) তাদের নিয়েই বাংলার পূর্বাঞ্চলে সর্বপ্রথমই একত্রিত হলাম জাতীয় পরিষদের সদস্যবৃন্দদের সাথে। যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সামনে সেদিন আমি আমার সহকর্মীবৃন্দের তরফ থেকে স্বাধীনতা কার্যকরী করার জন্য পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম। তখন যোগাযোগহীন অবস্থায় আপনাদের বেশিরভাগই ছিলেন বাংলাদেশে শত্রুর দখলকৃত এলাকার অভ্যন্তরে। অথচ একটা সরকার গঠন না করলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরিচালনা করা যাচ্ছিল না সেহেতু সেদিনের উপস্থিত বন্ধুদের কাছেই আমরা পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আরেকটি আম্রকাননে দাঁড়িয়ে আমরা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এবং বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি। স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৭ এপ্রিল সারা পৃথিবীর মানুষকে যা বলেছিলাম আমরা বিশ্বাস করি এ আপনাদের অন্তরের বাণী।  বিশ্বাস করি ১৭ এপ্রিলের এই ঘোষণা বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরের অন্তস্থলের মর্মবেদনার এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গরে বিরাট বিস্ফোরণ। স্বাধীনতা ঘোষণার পর আমি আমার সহকর্মী জনাব তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তার পরামর্শে এবং বঙ্গবন্ধুর পূর্বতন নির্দেশের বলে আমি জনাব খন্দকার মোস্তাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জনাব মনসুর আলী সাহেবকে অর্থমন্ত্রী, আর জনাব কামরুজ্জামান সাহেবকে স্বরাষ্টমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করেছিলাম। আমরা জানতাম আপনারা যে প্রয়োজনে তাদেরকে দীর্ঘকাল নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছিলেন, আমি আপনাদের সবার সঙ্গে পরামর্শ না করেও নিসংকোচে আর বিনাদ্বিধায় তাদেরকে সরকারের দায়িত্ব দিতে পারি।"

পাকিস্তানকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামের অবস্থান নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল তার কর্মদক্ষতা, সততা, দৃঢ়চেতা মনোভাব এবং কঠোর পরিশ্রম করে সমস্ত কর্মীদেরকে আস্থার ও শ্রদ্ধার আসন তৈরি করার মাধ্যমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম হয়ে উঠেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মী। ব্যক্তিজীবনে বা সামাজিক জীবনে কোন সম্পর্ক কখনই তাকে তার অভিষ্ট লক্ষ্য থেকে মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুত করতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হাজার হাজার বোমার আঘাতের মধ্যে যখন লক্ষ, লক্ষ আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানীরা হত্যার হোলিখেলায় লিপ্ত তখনও তিনি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে এই বৃহ্ৎ সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে পরিচালনা করার গুরুভার গ্রহণ করেন। একদিকে পাকিস্তানীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগণ শহর ছেড়ে জীবন, সম্মান রক্ষার তাগিদে গ্রামে, গ্রামান্তরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে ছাত্র, যুবকরা একত্রিত হয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাভূত করার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। দেশের আপামর জনগণ যখন অনিশ্চিত অবস্থায় দিনযাপন করছিল, তখন ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়ে তিনি বাঙালি জাতিকে আশ্বস্ত করতে পেরেছিলেন এই জনযুদ্ধ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্বেই শুরু হলো। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তিনি বিশ্ববাসীর সাহায্য চেয়ে আবেদন প্রচার করেন এবং পৃথিবীর যেখানে যত বাঙালি সকলকে এই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে আহ্বান জানান। এই কাজটি অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে নিপুনতার সাথে করার ফলে একদিকে যেমন বিশ্ব বাঙালি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাদের সমর্থন দিতে এগিয়ে এল, অন্যদিকে একইভাবে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ ও মানবপ্রেমিক রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ এবং আমাদের নিকটতম প্রতেবেশী সকল দেশের জনগণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিল এবং সম্পৃক্ত হলো।  

আমাদের মুক্তি সংগ্রামে সৈয়দ নজরুল ইসলামের অসামান্য অবদান ও তার নিরলস সংগ্রামের কিছু বর্ণনা তার জীবনী থেকেই দেওয়ার চেষ্টা করবো- "১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল এই তিন বছর আমি আপনাদের পরিচালনা করার দায়িত্ব লাভ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু এই তিন বছর কারাগারে ছিলেন (তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে)।  আইয়ুবশাহীর দাপট আর অত্যাচারে তখনও আপনারা অধৈর্য হন নাই। আমি কোনদিন ধৈর্য হারাই নাই। বহুবার আপনাদের বলেছি, সংগ্রামে জয়ী হতে হলে ধৈর্যের প্রয়োজন। বহুবার সংগ্রামের বহুকৌশল নিয়ে আপনাদের সাথে আমার মতবিরোধ হয়েছে। আমি আজ সগর্বের সাথে বলতে পারি আমার প্রবর্তিত কৌশলের ফলে আমরা ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত তথা আইয়ুবশাহীকে খতম করেছিলাম।   

বিশ্বাসের বলে আপনারা আমাকে আবার বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী হিসেবে প্রধান সহ-সভাপতি করেছিলেন। এই বিশ্বাসের বলে আপনারা আমাকে জাতীয় পরিষদে ডেপুটি নেতা করেছিলেন। আমি জানি এই বিশ্বাসের বলে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আবার আপনারা আমাকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিয়েছেন। আমার ভাগ্য এই যে, আমার নেতা আমার ভাই আমার প্রিয়তম বন্ধু শেখ সাহেব যখনই (জেলে) যান তার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব ঘাড়ে পড়ে যায়। সেই কাজ চিরকাল আপনাদের পাশে পাশে থেকে করেছি।"

মুক্তিযুদ্ধের ঊষালগ্নে প্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন ও সহযোগিতা জানাতে প্রবাস থেকে ১০ এপ্রিল আমি কলকাতা হয়ে প্রবাসী সরকারের নেতাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাই। অনেকদিন পরে সেখানেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের সাথে দেখা মেলে। এতো বিপদ এতো কর্মযজ্ঞ এবং এতো মানুষের যুদ্ধকালীন প্রত্যাশার মধ্যেও প্রথম দেখায়ই তিনি যেভাবে আমাকে আপন করে গ্রহণ করলেন তাতে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি আমাদের সকলের পিতা ও অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন দরদ দিয়ে ও মমতা সহকারে। হাজারও সমস্যা জর্জরিত প্রতিটি দিনের যুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ডে যখনই আমরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছি অথবা কর্তব্য ঠিক করতে ইতস্তত করেছি অথবা কোন সন্দেহ আমাদেরকে বিব্রত করেছে অন্য কারোও কাছ থেকে সমাধান যখন পাওয়া যেত না, আমাদের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি তখনই আমাদের জন্য অভয়ের বাণী নিয়ে আসতেন। মুক্তিযুদ্ধকালে রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বশেষ দায়িত্ব তার উপর ছিল তারপরও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে প্রতিটি সিদ্ধান্ত তার সম্মতি নিয়ে করার চেষ্টা আমাদের নেতারা সবসময় করেছেন। যার ফলে অত্যন্ত সফলতার সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পর্যায়ে আমরা সফল হতে সক্ষম হয়েছি। আমি হয়তো ভুরি ভুরি উদাহরণ দিতে পারবো, কিন্তু আজ দীর্ঘ সময় পরে একথা স্বাচ্ছন্দ্যে বলা যায় যে, ভারতে আমাদের কোটি মানুষ আশ্রয় দিয়েছিল সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা বর্তমান ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের সমর্থনে মুসলিম বিশ্বের প্রায় সকল দেশ এবং তাদের অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জয়ের বিরুদ্ধে। ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে কলকাতায় আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সকল দেশের গোয়েন্দারা তৎপর ছিল। আমেরিকান সিআইএ এর বাংলাদেশবিরোধী অংশটি কলকাতায় অবস্থান করে মোস্তাক, জহিরুল কাইয়ুম এদের মাধ্যমে প্রবাসী সরকারকে প্রতিনিয়ত বিব্রত করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। এতে অংশ নিয়েছিল মাহবুব আলম চাষী, তাহের উদ্দীন ঠাকুর ও কলকাতাস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কিছু কর্মকর্তা। এর ফলে কলকাতায় বসেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাহত বা প্রলম্বিত করার একটা প্রচেষ্টা চলতে ছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলামের দক্ষতার কারণেই আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বহু বিপদ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছিল। তার ব্যক্তিগত ইমেইজ আমাদেরকে সাহায্য করেছিল বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালি প্রভাবশালী ও প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সহজভাবেই মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে অবস্থান নিতে ও আমাদেরকে সাহায্যের হাত বাড়াতে। সদাহাস্য এই মানুষটি মৃতুদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ আর বাংলার মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত রেখে খুনী মোস্তাকের হাতে অকাতরে প্রাণ দিতে দ্বিধাবোধ করলেন না।  ১৯৭৫ এর ৩রা নভেম্বর রাতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের একটি অংশ মোস্তাকের নির্দেশে জেলের অভ্যন্তরে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ইতিহাসের প্রতিশোধ আজ মোস্তাককে ঘৃণাভরে অন্ধকারকূপে নিক্ষেপ করেছে আর সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। দেশপ্রেমিক মানবজাতির অভিধানে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন এই পুতপবিত্র মানুষটি। আর তারই প্রেরণা নিয়ে জাতির পিতার আদর্শ অনুসরণ করে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলার মানুষকে তাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা উপহার দেবেন এই হোক আজ আমাদের প্রত্যয়।       

লেখক : সভাপতি, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ 

বিডি-প্রতিদিন/১০ অক্টোবর, ২০১৮/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর