৪ এপ্রিল, ২০২১ ০৯:২২

অভিনেতার মুখোশটা খুলে মানুষ বেরিয়ে আসুক

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

অভিনেতার মুখোশটা খুলে মানুষ বেরিয়ে আসুক

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

অভিনয় আর বাস্তবতার অবস্থান খুব কাছাকাছি হলেও চারিত্রিক দিক থেকে দু'টো ঠিক বিপরীতমুখী। মানুষের ভিতরে এই দু'টো উপাদান সব সময় সক্রিয় থাকে। মানুষ তার সুবিধা অনুযায়ী মুখোশ পাল্টে যখন যেটা প্রয়োজন হয় তখন সেটা গ্রহণ করে। কারণ মানুষের মতো সুবিধাবাদী আর স্বার্থপর প্রাণী পৃথিবীতে আর একটিও নেই। তারপরও কিছু কিছু মানুষ তো থাকে যাদের স্বার্থটা নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্য দৃশ্যমান হয়। তবে সেটা নাকের দু'পাশের চোখ দিয়ে দেখে বোঝাটা খুব কঠিন। মন দিয়ে হয়তো বোঝা যায় যদি মানুষের মন থাকে। মনের ভিতরে মানুষ থাকে।  কারণ মানুষের মন তো এখন দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে। 

কোনটা অভিনয় আর কোনটা বাস্তবতা তা যাচাই করার জন্য ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির মতো কোনো জটিল গাণিতিক সমীকরণও তো নেই। দুই ইংরেজ পরিসংখ্যানবিদ- ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ এবং টনি লুইস এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। এটি নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। কিভাবে জেতা খেলায় পরাজয়ের গ্লানি টানতে হয় এই গাণিতিক সমীকরণটি যাদের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে তারা হয়তো বুঝেছে তবে সেই জয় পরাজয় অভিনয় না বাস্তবতা তা কেউ কখনো হয়তো পরখ করে দেখেনি। 

মানুষের জীবন ক্রিকেটের ম্যাচ নয়, ম্যাচ ফিক্সিংয়ের মতো অভিনয় করে বাজি ধরা টাকার অংকের সাথে জয় পরাজয় নয়। তারপরও তো মানুষের জীবন। খুব অবাক হতে হয় যখন সে জীবন বাস্তবতার চেয়ে অভিনয়কে প্রাধান্য দেয়। মানুষের চামড়ার মুখটার চেয়ে অভিনেতার মুখোশ পরা মুখটাকে প্রাধান্য দেয়।

জীবন কি তবে একটা নাটক। নাটকের ভিতরের নাটক, যে নাটকে বিশ্বাস নেই, বিশ্বাসঘাতকতা আছে। যে নাটকে ভালোবাসা নেই, আঘাত আছে। যে নাটকে বাস্তবতা নেই, শীতল যুদ্ধের মতো টান টান নাটকীয়তা আছে। উইলিয়াম শেকসপিয়রের অন্যতম মিলনান্তক নাটক  "এজ ইউ লাইক ইট" এর ২য় অঙ্কের ৭ম দৃশ্যে বিষন্ন জ্যাকসের একটা সংলাপ ছিল এমন "পুরো পৃথিবী একটা রঙ্গমঞ্চ আর প্রতিটি নারী ও পুরুষ সেই মঞ্চের অভিনেতা। এ মঞ্চে প্রবেশপথও আছে, আবার বর্হিগমন পথও আছে। জীবনে একজন মানুষ এই মঞ্চে অসংখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন"।

অভিনেতা হুমায়ন ফরীদি প্রায় নাকি বলতেন, নিজে বাঁচো, অন্যকে বাঁচতে দাও। জীবনের দুঃসহ বাস্তবতাকে খুব কাছ থেকে দেখে তিনি গভীর উপলব্ধিতে আরও বলেছেন, "প্রেমের আরেকটা দিক হচ্ছে না বুঝা। কেন প্রেমে পড়লাম, কেন ভালোবাসলাম এর কারণ যদি তুমি খুঁজতে যাও তবে দেখবে যে তুমি কিছুই খুঁজে পাচ্ছো না। মানে একটা কালো বেড়াল অন্ধকার ঘরে তুমি খুঁজে বেড়াচ্ছ যেটা ঐ ঘরে নাই। প্রেমটা এই রকম। 
কিছু কিছু পরিবর্তন মানুষ নিজেই করে আর কিছু কিছু পরিবর্তন মানুষের জীবনে আসে যেটা সে কখনোই চায়না, কখনোই আশা করে নাই। এরকম অনেক জিনিস ঘটে সেটা আমার জীবনে বহুবার ঘটেছে। আমি যেটা করতে চেয়েছি, সেটা করতে পারিনি। আমি যাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি, সে আমাকে ফেলে চলে গেছে বা যাকে স্নেহ আমি দিতে গেছি, সে আমাকে ঘৃণা করেছে"।

জীবনের কঠিন সত্যের কথা বলেছেন তিনি। বরফের কঠিনের চেয়েও কঠিন। সারাজীবন মানুষকে অভিনয় দিয়ে বাস্তবতাকে চিনতে বলেছেন।  মঞ্চের অভিনেতা হয়েও যেন তিনি অভিনয় করেননি বরং অভিনয়কে অতিক্রম করে বাস্তবতাকে আঁকড়ে ধরেছেন। তাই তিনি উদারভাবে বেঁচে থাকা, প্রেম ও চাওয়া না পাওয়ার এমন বাস্তবতা আত্মার গভীরের দর্শনতত্ত্ব থেকে দিতে পেরেছেন। অথচ যে মানুষটা অভিনয়ে নেই, সে মানুষটা বাস্তবতাকে আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে অভিনেতা হয়ে উঠেছেন। বিষয়টা খুব বিস্ময়কর আমরা যাকে অভিনেতা ভাবছি তিনি বাস্তব পৃথিবীর মানুষ, অথচ যিনি অভিনেতা নন তিনি স্বার্থপরতার রং মুখে মেখে রীতিমতো অভিনেতা হয়ে উঠেছেন। এ কেমন সত্যের ভিতর অসত্যের খেলা। মানুষ যা বলে তা হয়তো সত্য নয়, মানুষ যা বলতে চায়না সেটাই হয়তো সত্য। এই না বলাটা একধরণের অভিনয়। সেটা যে মানুষটা করে সে জানে সত্যটা মানুষ জানলে তার আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসবে। একটা জোকার মানুষকে হাসায় কিন্তু সে নিজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। কারণ পৃথিবীর মানুষের মতো সে অভিনেতা নয়, পেটের দায়ে সে নিজে হাসতে না চাইলেও তাকে মানুষকে হাসাতে হয়। তবে তার কাছে অভিনয়টা মূল্যহীন, বাস্তবতার সাথে লড়তে লড়তে জীবনে বেঁচে থাকাটাই মূল্যবান। কিন্তু জোকারটা জানে তার মৃত্যুতে পৃথিবীর মানুষ কাঁদবে না কিন্তু যিনি অভিনেতা না হয়েও অভিনয় করে চলেছেন তার মৃত্যুতে সারা পৃথিবীর মানুষ কাঁদবে। কারণ মানুষ মানুষের জন্য কাঁদে না, বাস্তবতার নাম ভাঙিয়ে যে অভিনেতার মুখোশটা পড়ে থাকে তার জন্য কাঁদে। খুব নির্মম এই বাস্তবতা, যেন নিয়তির পরিহাস। 

অভিনয় করতে করতে মানুষ একদিন তার ভিতরের মানুষকে হারিয়ে ফেলে। সে হারানোটা আলো নিভে যাবার মতো। দীপ জ্বেলে যাই সিনেমাটার কথা মনে পড়ে গেলো। ১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় বাংলা ভাষার একটি সামাজিক-নাট্যধর্মী চলচ্চিত্র এটি। চলচ্চিত্রটির মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন ও বসন্ত চৌধুরী। এটি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছোট গল্প নার্স মিত্র কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। অনেকটা পুরাতন, অথচ তারপরও কোথায় যেন অভিনয়ের চেয়েও এখানে বড় হয়ে উঠেছে বাস্তবতার আকুতি। না বলা শব্দের না দেখা ব্যাকুলতা। 

এই সিনেমার ঘটনাটা অনেকটা এমন: মানসিক হাসপাতালের সেবিকার কাজ করে রাধা। আর আট দশটা মেয়ের মতো একটা সাধারণ বাঙালি মেয়ে সে। প্রজাপতির মতো ভাবনাগুলো তার। মানসিক চিকিৎসায় খ্যাতিমান প্রধান চিকিৎসকের নির্দেশে মানসিক রোগীদের ভালো করে তুলতে রাধা তাদের সঙ্গে মিথ্যা প্রেমের অভিনয় করতে থাকে। এভাবে একের পর এক মানসিক রুগীর সাথে তাকে মিথ্যা প্রেমের অভিনয় করে যেতে হয় । এই মিথ্যা প্রেমের অভিনয়ের মাধ্যমে রুগীদের সারিয়ে তুলে রাধা। কিন্তু এইভাবে মিথ্যা প্রেমের অভিনয় করতে করতে একদিন রাধা সেই হাসপাতালে আসা মানসিক রুগী তাপসের সত্যিকারের প্রেমে পড়ে যায়। অসুস্থ থাকতে তাপস রাধাকে বলেছিলো সে রাধাকে খুব ভালোবাসে, সে রাধা ছাড়া বাচঁবেনা। রাধাকে বিয়ে করে তার বউয়ের মর্যাদা দিবে। কিন্তু তাপস সুস্থ হলে তার আগের সব কথা ভুলে যায়। রাধাকে সে চিনতে পারে না। কিন্তু রাধা যে তাপসকে খুব গভীর সত্যের উপর দাঁড়িয়ে ভালোবেসেছিলো। এক একটা করে স্বপ্নের জাল বুনেছিল। তাপস সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু এ ঘটনায় রাধা মানসিকভাবে আঘাত পেয়ে ভেঙে পড়ে। একদিন যে প্রেমের অভিনয় করতে করতে মানসিক রুগীদের ভালো করে তুলেছিল সেই রাধা আর অভিনয় করতে পারেনি, সত্যিকারের ভালোবাসার আঘাত পেয়ে সে শেষ পর্যন্ত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সবাই বাড়ি ফিরে যায় একে একে আর রাধার জায়গা হয় মানসিক হাসপাতালের চার দেওয়ালের বন্দিত্বে। 

আমরা আর মিথ্যা  অভিনয় চাই না, স্বার্থের অভিনেতা চাই না। মানুষ চাই, মানুষ। যেখানে জনপদের পিচ ঢালা কঠিন পাথরের আস্তরণ পেরিয়ে মানুষ ক্রমশ অভিনেতার মুখোশটা ছুড়ে ফেলে মানুষ হয়ে উঠবে। আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখা জীবনের মানুষটা কাচের আয়না থেকে বেরিয়ে   বাস্তবতার মানুষ হয়ে উঠবে।


বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর