মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রাণহীন নববর্ষ ১৪২৭

প্রাণহীন নববর্ষ ১৪২৭

এবার পয়লা বৈশাখে দেখা যাবে না মঙ্গল শোভাযাত্রা। ফাইল ছবি : রোহেত রাজীব

খাজনা পরিশোধের গরমিলে পড়ে যেত বাংলার কৃষক। তাই প্রাচীন বর্ষপঞ্জি সংস্কারের নির্দেশ দেন সম্রাট আকবর। প্রথমে এ সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পায়। বাঙালির সার্বজনীন লোক উৎসব পয়লা বৈশাখ। এক সময় মেলা, হালখাতা আর পুণ্যাহ উৎসব ছিল পয়লা বৈশাখের প্রাণ। বৈশাখী মেলায় থাকত গ্রামের কামার-কুমার আর তাঁতিদের হস্তশিল্পের আয়োজন। থাকত হাতে তৈরি মাটির খেলনা, মন্ডা-মিঠাই, চরকি, বেলুন, ভেঁপু। মেলার প্রধান আকর্ষণ ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই ছিল জনপ্রিয়। সময়ের পালাবদলে নগরজীবনে পয়লা বৈশাখ উৎসব আয়োজনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আশির দশকে নতুন আঙ্গিকে, নতুন উচ্ছ্বাসে বৈশাখী উৎসব জমে ওঠে। এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সব ধরনের জনসমাগমে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। সরকার তাই বাতিল করেছে নববর্ষের নানা আয়োজন ও মঙ্গল শোভাযাত্রা। তবে বাঙালির ঐতিহ্য আর চিন্তা চেতনা থেমে থাকবে না। ঘরে বসেই সবাই নতুন বছরের স্বাদ নেবে। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করবে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির। লিখেছে - তানভীর আহমেদ

 

হচ্ছে না অনুষ্ঠান ও মঙ্গল শোভাযাত্রা

করোনার কারণে কোনো কিছুই এখন আর স্বাভাবিক নেই। এমন পরিস্থিতি তো শোভাযাত্রা করার মতো নয়। আমরা শোভাযাত্রায় মানুষকে আহ্বান করি একটি জায়গায় মেলার জন্য। এই সময়ে এক জায়গায় মিলতে চাওয়া তো একটা আত্মঘাতী কাজ হবে।

বৈশাখ উপলক্ষে রমনা বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতি আয়োজন কিংবা চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা পয়লা বৈশাখ উদযাপনের প্রধান দুই আয়োজন। তবে এবার করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না এই দুই আয়োজনের একটিও। যদিও এর আগে বিকল্প ব্যবস্থায় আয়োজন দুটি করার কথা জানানো হয়েছিল আয়োজকদের পক্ষ থেকে, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে হচ্ছে না তাও। এমনটাই জানিয়েছেন ছায়ানটের সহ-সভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন। ছায়ানটের প্রভাতি আয়োজন নিয়ে ছায়ানটের সহ-সভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, উৎসব নয়, এখন দুর্যোগ প্রতিরোধের সময়। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম অনুষ্ঠান আগে ধারণ করে মিডিয়ার জন্য কিছু করা যায় কি না। সেটা হচ্ছে না। কেননা সেটির জন্যও জনসমাগম তৈরি হয়। আগে আমাদের নিজেদের নিয়ে ভাবতে হবে। সার্বিকভাবে দেশ এবং দেশের বাইরে পরিস্থিতি, যে মৃত্যুর মিছিল আমরা দেখছি, তাতে আমাদের খুবই ভারাক্রান্ত। আয়োজন যতই সীমিত করি না কেন, সেখানে মানুষের সমাগম ঘটবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষকে আসতে বলা বা মহড়া করতে আসতে বলাটাও সম্ভব হচ্ছে না। পরিস্থিতিটা এমন হয়ে গেছে, এটা আসলে সম্ভব হচ্ছে না এ বছর। খায়রুল আনাম শাকিল আরও বলেন, ছায়ানট শুধু গান শেখার প্রতিষ্ঠান তো নয়, বরং যে কোনো ক্রান্তিকালে এটি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং এখনো গরিব ও দুস্থদের সাহায্যের মাধ্যমে ছায়ানট সবার পাশে থাকতে চায়। তাই আমরা অন্য একটা উদ্যোগ নিয়েছি, তা হচ্ছে এ সময় আমরা দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। যেটা ছায়ানট সবসময় করে আসছে জাতীয় দুর্যোগের সময়, বন্যার সময়, দুর্ভিক্ষের সময় আমরা সাধ্যমতো সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, করোনার কারণে কোনো কিছুই এখন আর স্বাভাবিক নেই। এমন পরিস্থিতি তো শোভাযাত্রা করার মতো নয়। আমরা শোভাযাত্রায় মানুষকে আহ্বান করি একটি জায়গায় মেলার জন্য। এই সময়ে এক জায়গায় মিলতে চাওয়া তো একটা আত্মঘাতী কাজ হবে। পরিস্থিতি যা, সেটি আসলে মঙ্গল শোভাযাত্রা করাকে অনুমোদন করে না। বর্তমান পরিস্থিতিও আমাদের অনুকূলে নেই। এদিকে প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ১৪২৭ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ উদযাপনে এ বছর ১৪ এপ্রিল কোনো অনুষ্ঠান না করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এবার সরকারিভাবে পয়লা বৈশাখের যাবতীয় অনুষ্ঠান ও কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ কথা জানানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘করোনাভাইরাসজনিত রোগ (কভিড-১৯)-এর বিস্তার রোধকল্পে জনসমাগম পরিহার করার লক্ষ্যে আসন্ন পয়লা বৈশাখ ১৪২৭ তারিখের সব কার্যক্রম স্থগিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা যাচ্ছে। এখানে সারা দেশে পয়লা বৈশাখের পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলায় ‘বৈসাবি’ উৎসব স্থগিতের ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত : ১৯৬৭ সাল থেকে নিয়মিতভাবে রমনার বটমূলে আয়োজিত হয়ে আসছে ছায়ানটের পয়লা বৈশাখ উদযাপনের আয়োজন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বছরটি বাদে নিয়মিতভাবে চলেছে রাজধানীবাসীর পয়লা বৈশাখ উদযাপনের প্রধান এ আয়োজনটি। এমনকি ২০০১ সালে বোমা হামলার পরের বছরেও এ আয়োজনের ছেদ পড়েনি। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে প্রথমবারের মতো মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। যা ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হয়।

যেভাবে এলো বাংলা নববর্ষ

মুঘল সাম্রাজ্য ছিল বিশাল। সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলা সনের যাত্রা শুরু হয়। আকবর ক্ষমতায় আসেন ইংরেজি ১৫৫৬ সালে। সে সময় হিজরি ক্যালেন্ডার ধরে রাজকার্য পরিচালনা হতো। চান্দ্রবর্ষ ব্যবহারে কিছু জটিলতা দেখা যায়। কারণ সৌরবর্ষের তুলনায় ১০-১১ দিন কম থাকায় চান্দ্রবর্ষ কখনই পরের বছর একই দিনে আসে না। জমির খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে কৃষকদের তাই জটিলতার মধ্যে পড়তে হতো। এ ছাড়া ঋতু অনুযায়ী ফসলে চাষ হতো। যে কারণে ফসল না তুলতেই খাজনার সময় এসে গেলে কৃষক পড়ত বিপাকে। ভারতবর্ষ বিশাল হওয়ায়, সেখানে নানা ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মীয় আচার পালনেও বর্ষপঞ্জির জটিলতায় পড়ত। জমির খাজনা মেটাতে তাই সম্রাট আকবর ফসলি সন তৈরির দিকে নজর দেন। মুঘল বাদশাহদের মধ্যে তার রাজসভায় ছিল সবচেয়ে গুণী-পন্ডিতদের আনাগোনা।

সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৯) নির্দেশে এবং বিজ্ঞ রাজ জ্যোতিষী ও প-িত আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজী বাংলা সন তৈরিতে গবেষণা শুরু করেন। হিজরি সনের জটিলতা এড়িয়ে সৌর সন ধরে তিনি ‘ফসলি সন’ তৈরি করেন। এতে করে সৌর বর্ষের সঙ্গে হিজরি সনের যে ব্যবধান ছিল তা আর রইল না। সৌর সন ধরেই এলো ‘ফসলি সন’। ঋতুভিত্তিক সৌর সন থেকে আসা ফসলি সনে জমির খাজনা আদায়ের জটিলতা অনেকটাই কেটে যায়। তখনকার প্রচলিত হিজরি সনকে ‘ফসলি সন’ হিসেবে চালু করার মাধ্যমে বর্তমান বাংলা সন বঙ্গাব্দের জম্ম হয়। বাংলা সনের জš§লাভের পর পরবর্তীতে এ পঞ্জিকার হিসাবে তখনকার বার্ষিক কর, ভূমি কর, কৃষি কর, জল কর ইত্যাদি আদায় শুরু হয়। তথ্য অস্পষ্টতার জন্য অনেকে মনে করেন, সম্রাট আকবরের হাতেই বাংলা সনের গণনা শুরু।

কিন্তু প্রকৃত বিষয় হলো সম্রাটের হাতে হিজরি সনকে রূপান্তরের মাধ্যমে বাংলা সনের প্রবর্তন ঘটে। দিনে দিনে এই বাংলা বছর গণনায়ও এসেছে নানা পরিবর্তন। শুরুতে বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গাব্দের দিন ও তারিখ নির্ধারণে জটিলতা পরিলক্ষিত হয়। এসব জটিলতা নিরসনে প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বঙ্গাব্দের বেশ কিছু সংস্কার করেন। যেমন গণনার সুবিধার্থে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত দিনের সংখ্যা প্রতি মাসে ৩১ করা হয় এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ৩০ দিন গণনার বিধান করা হয়।

 

ইতিহাসে রমনা বটমূলে

ছায়ানটের বর্ষবরণবাংলাদেশের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে, সবাইকে নিয়ে পয়লা বৈশাখের আনন্দ ভাগাভাগির উৎসবের কেন্দ্রে থাকে  ছায়ানটের রমনা বটমূলে বর্ষবরণ সংগীত ও মঙ্গল শোভাযাত্রা। ছায়ানটের যাত্রা, বাংলার মানুষকে সাংস্কৃৃতিক মুক্তিতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। ছায়ানট বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৬১ সালে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন করা ছাড়াও এ সংগঠন বাদ্যযন্ত্র, সংগীত, নৃত্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান ও সংগীত বিদ্যালয় পরিচালনা করে থাকে। পয়লা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ রমনার বটমূলে ছায়ানটের পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জš§শতবার্ষিকী উৎযাপনের পর একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগেই এর যাত্রা। মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই নামে পরিচিত), শামসুন্নাহার রহমান, সুফিয়া কামাল, ওয়াহিদুল হক ছিলেন উদ্যোগের পেছনে। সাঈদুল হাসানের প্রস্তাবে সংগঠনটির নামকরণ করা হয় ছায়ানট। সুফিয়া কামালকে সভাপতি আর ফরিদা হাসানকে সম্পাদক করে প্রথম কমিটি গঠিত হয়। ওই বছর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ছায়ানটের প্রথম পুরনো গানের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৩ সালে সনজীদা খাতুনের উদ্যোগে বাংলা একাডেমির বারান্দায় সংগীত শেখার ক্লাস শুরু হয়। ইংরেজি ১৯৬৪ সাল, বাংলা ১৩৭১ সনের ১ বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানট বাংলা নববর্ষ পালন শুরু করে। কালক্রমে এ নববর্ষ পালন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। ছায়ানটের বর্ষবরণ গানে বাংলা নতুন বছরকে আহ্বানের মধ্যদিয়ে এখন নববর্ষের দিন শুরু করে নগরবাসী।

 

নির্বাচিত ভিডিওতে এবারের বর্ষবরণ

রমনা বটমূলে বর্ষবরণের ৫৬ বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো সেই অনুষঙ্গ উদযাপনে ছেদ পড়ছে। এবার রমনায় হবে না বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। এবার আর রমনার বটমূলে কেউ গাইবে না বর্ষবরণের গান ‘এসো হে বৈশাখ...’। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সব ধরনের জনসমাগম বন্ধ থাকায় রমনার বটমূলে নেই ছায়ানটের কোনো অনুষ্ঠান। স্বাস্থ্য সতর্কতা মেনেই নিয়মিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ও মিলনমেলার আয়োজন থেকে সরে এসেছে তারা। এর বদলে ছোট পরিসরের একটি অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে টেলিভিশন চ্যানেলে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে বর্ষবরণের এই টিভি অনুষ্ঠান ধারণ করার মতো অবস্থাও নেই। ফলে রমনার বটমূলে গত কয়েক বছর ধরে যে অনুষ্ঠান পরিবেশন করে এসেছে ছায়ানট, তারই ধারণকৃত ভিডিও দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবারের টিভি অনুষ্ঠান। ছায়ানট সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকটি বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের নির্বাচিত ভিডিও দিয়ে সাজানো অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হবে পয়লা বৈশাখ সকাল ৭টায়। তাতে আগের বছরের আয়োজনের অংশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্তমান সংকটের প্রেক্ষাপটে ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুনের সমাপনী কথন। বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়াও অনুষ্ঠানটি একইসঙ্গে ছায়ানটের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল ছায়ানট ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও সম্প্রচারিত হবে। ইংরেজি ১৯৬৪ সাল, বাংলা ১৩৭১ সালের ১ বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানট বাংলা নববর্ষ পালন শুরু করে। কালক্রমে এই নববর্ষ পালন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের জন্য এই আয়োজন বন্ধ ছিল। এ বছর আবার করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এই আয়োজনে ব্যাঘাত ঘটাল।

 

ফসলি সন থেকে বাংলা পঞ্জিকা

এই বাংলার ইতিহাসে কৃষি আর কৃষকের গল্প অনেক। প্রকৃতি, কৃষিজীবন নানাভাবে এই অঞ্চলের মানুষের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। বাংল পঞ্জিকা বা বাংলা সনের হিসাবের গোড়াপত্তন হয়েছে ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে। এর আগে ফসলি সন ধরে চলত ঋতুধর্মী উৎসব। ফসল উত্তোলন গণনায় বর্ষপঞ্জি নিয়ে বিভেদ দূর করতেই প্রয়োজন পড়ে বাংলা বর্ষপঞ্জির। চন্দ্র সন অনুযায়ী কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা হতো তখন। কিন্তু সৌরবর্ষ থেকে ১০-১১ দিন পিছিয়ে যায় চন্দ্র সন। অনিয়মতান্ত্রিক খাজনা পরিশোধের গরমিলে পড়ে  যেত বাংলার কৃষক। তাই প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার নির্দেশ দেন সম্রাট আকবর।   প্রথমে এ সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পায়।

বৈশাখী ছুটি শেরেবাংলার অবদান

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলার ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। বাংলার মানুষের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত রচনা করেছিলেন তিনি। বাংলায় স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনেছেন। জনমানুষকে বাংলার শেকড়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়েছেন তিনি। পয়লা বৈশাখ বাংলা বছরের প্রথম দিন। এই দিনটির গুরুত্ব ও উৎসবমুখর আবহাওয়া নতুন করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। গ্রাম-বাংলার খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষিজীবী মানুষের ভাষা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। জানতেন শহুরে মানুষের কাছে সাংস্কৃতিক উৎসবের ছোঁয়া কীভাবে এনে দিতে পারে নতুনের লড়াইয়ের শক্তি। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ উৎখাত হয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন। এটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুস্পষ্ট ধারণা উপলব্দি করার ঐতিহাসিক এক ঘোষণা।

ইউনেস্কোর তালিকায়  মঙ্গল শোভাযাত্রা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখ সকালে এ শোভাযাত্রা বের হয়। এ শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন অনুষঙ্গের উপস্থাপনায়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় সব শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। ১৯৮৯ সাল থেকে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা সবার কাছে বৈশাখী উৎসবের অন্যতম একটি আকর্ষণ হয়ে আছে। শোভাযাত্রার অন্যতম আকর্ষণ বিশালাকার চারুকর্ম পুতুল, হাতি, কুমির ও ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ ও সাজ-সজ্জাসহ বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালাকার হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নাচে-গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ ধারা অব্যাহত রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এ আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর মানবতার অধরা বা অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।

নতুন দিনের আহ্বান

হালখাতা

ফসলি সনে জমির খাজনা আদায় করতেন জমির মালিক। পাওনাদার মিটিয়ে দিতেন বাকি। পাড়া-পড়শি, ক্রেতা-বিক্রেতাকে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করেই নতুন করে বছর শুরু করতেন কৃষক, ব্যবসায়ী, জমিদাররা। পুণ্যাহ আর হালখাতা বাংলা নববর্ষের শেকড় বললে ভুল হবে না। এখন পুণ্যাহ তেমন পালন না হলেও হালখাতার প্রচলনটা রয়ে গেছে। ক্রেতার সঙ্গে সম্পর্কটা ঝালিয়ে নিতে হালখাতা খুলে বসেন বিক্রেতা বা দোকানদার। পুরনো বছরের পাওনা, বাকি যা আছে মিটিয়ে দিয়ে ক্রেতাও নতুন করে বাকির খাতা খুলতেন। দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে তারপর মিষ্টিমুখ করত দুই পক্ষই। আবহমান গ্রাম-বাংলায়  ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক রচনার এই মাধুর্য হালখাতা অনুষ্ঠানেই কেবল দেখা যায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট-বড় মাঝারি যে কোনো দোকানেই হালখাতার উৎসবের আমেজ পাওয়া যায়। মূলত পঁচিশে বৈশাখের সকালে সনাতন ধর্মাবলম্বী দোকানি ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করে থাকেন এই কামনায় যে, তাদের সারা বছর যেন ব্যবসা ভালো যায়।

ঐতিহ্যের যত উৎসব

পয়লা বৈশাখের আনন্দ উৎসবে গ্রাম-বাংলার লোকজ মেলার কথা আলাদা করে না বললেই নয়। সব বয়সী মানুষ এ মেলার জন্য মুখিয়ে থাকত এক সময়। বৈশাখী মেলা মানেই ছিল গ্রামের মানুষের বাৎসরিক উৎসবের দিন। এ মেলায় থাকত তাঁতে বোনা পোশাক, মাটির খেলনা, গৃহস্থালি দ্রব্য হাঁড়ি-পাতিল। বাচ্চাদের জন্য খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন- চিঁড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা ও বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়ক ও লোকনর্তকদের উপস্থিতি থাকে। তারা যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদী-ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন। নাটক, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের আকর্ষণের জন্য থাকত বায়োস্কোপ। হালখাতা আর পুণ্যাহ উৎসব ছিল বৈশাখী উৎসবের প্রাণ। ঘোড়দৌড়, ষাড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, পায়রা ওড়ানো, ঘুড়ি ওড়ানো, গরুর দৌড় প্রতিযোগিতা ছিল জনপ্রিয়। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে নৌকাবাইচ, বহুরূপীর সাজ, হাডুডু খেলার আয়োজনও থাকত। গ্রামবাংলার জনপ্রিয় অনেক খেলার প্রচলন এখন আর নেই। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। যেমনÑ চট্টগ্রামের বলিখেলা এবং রাজশাহীর গম্ভীরা এখনো টিকে আছে।

বটতলার মেলা

বটতলার মেলার জন্য সারা বছর গ্রামের মানুষ মুখিয়ে থাকত এক সময়। এখন বৈশাখী মেলার আয়োজনে অনেক পরিবর্তন এলেও মেলার আবেদন এতটুকু কমেনি। গ্রামে পয়লা বৈশাখের মেলা বসত বটতলায়। গ্রামের সবচেয়ে উঁচু, পুরনো বটতলায় এ মেলা বসত বলে একে বটতলার মেলা বলেই লোকে ডাকত। এ মেলায় গ্রামের কামার-কুমার আর তাঁতিদের হস্তশিল্পের আয়োজন থাকে। স্থানীয় কুমারের হাতে তৈরি মাটির খেলনা, মন্ডা-মিঠাই, চরকি, বেলুন, ভেঁপু, বাঁশি আর ভাজাপোড়া খাবার-দাবার মেলার প্রধান আকর্ষণ। বাড়ির পাশের এ মেলায় ছেলে-বুড়ো সবার উপস্থিতি সমান। এ মেলা যেন গ্রামবাসীর আদি উৎসবের ডাক দিয়ে যায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর