নব্বইয়ের দশকে ছিল পুরোটাই আমদানিনির্ভর। এখন পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ। রপ্তানিও হচ্ছে। এমনকি চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ উৎপাদন ক্ষমতা কারখানাগুলোর। এ কারণে ছোট-বড় সব ব্র্যান্ডের সিমেন্টের অবিক্রীত থাকার মতো অবস্থা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বাজারে যা তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে সিমেন্টের। অনেকটা নীরবে-নিভৃতে এগিয়ে যাওয়া সম্ভাবনার সিমেন্ট শিল্প নিয়েই পজিটিভ বাংলাদেশের প্রথম আয়োজন।
আশির দশকের পরে দেশের প্রবাসী আয় সূচকের তীর ওপরের দিকে উঠতে থাকে। প্রবাসী আয়ের সূচকের সঙ্গে দেশের ডলার সরবরাহে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে শিল্প খাতে। এর প্রভাবে গার্মেন্টশিল্পের পর ভারী শিল্প খাতে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটিয়েছে যেসব খাত তার মধ্যে সিমেন্ট খাত অন্যতম। তবে সিমেন্ট খাতের বর্তমান এই উন্নয়ন বা অন্যতম প্রধান খাতে পরিণত হয় গত ২০ বছরে। নব্বই দশকে দেশের নির্মাণ খাতের বিপুল পরিমাণ চাহিদার পুরোটাই মেটানো হতো আমদানি করে। পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে নব্বই দশকের পর থেকে। প্রথম পাইওনিয়ার হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপ বেসরকারি খাতের সিমেন্ট শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ করে। সেই ছোট্ট বিনিয়োগ আজ দেশের নির্মাণ খাতের চিত্র বদলে দিয়েছে। এখন দেশে প্রায় ৪০টির বেশি সিমেন্ট শিল্প কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে উৎপাদনে রয়েছে ৩৫টির মতো। এসব কারখানায় দেশীয় চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ উৎপাদন ক্ষমতা রাখে। জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে দেশের বিশাল উন্নয়ন প্রকল্পগুলো চালু হয়। একই সঙ্গে সরকারের বৃহৎ প্রকল্পগুলোর কাজ শুরু করায় চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। এই চাহিদার কারণে দেশে সিমেন্টের বাজার বাড়ছে। এ সময় দেশের মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রভাবে বাড়ি নির্মাণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড বেড়েছে। সব ধরনের নির্মাণ কাজ বাড়ায় চাহিদা বাড়ছে। এসব নির্মাণ খাতে বেশির ভাগের সরবরাহ আসছে স্থানীয় কারখানা থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা মেনে গুণগত মান, সরবরাহের সক্ষমতা কিংবা বিপণন কৌশল প্রণয়নে সিমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে। ফলে বিদেশি সিমেন্টের চেয়ে বাজারের বড় অংশ দেশি সিমেন্টের দখলে। প্রথাগত পদ্ধতির বাইরেও এখন সিমেন্ট কোম্পানিগুলো রেডিমিক্স নিয়ে এসেছে। রেডিমিক্সের বাজার চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। জানা গেছে, ১৯৪১ সালে দেশে প্রথম সিমেন্ট কারখানা চালু হয় বর্তমান বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে। সিলেটের ছাতক উপজেলার সুরমা নদীর তীরে আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানি স্থাপন করা হয়। স্বাধীনতার পরে দেশের একমাত্র এ কারখানা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীনে ছাতক সিমেন্ট নামে উৎপাদন অব্যাহত রাখে। ১৯৭৩ সালে চিটাগাং সিমেন্ট ক্লিংকার অ্যান্ড গ্রাইন্ডিং ফ্যাক্টরি নামে আরেকটি কারখানা স্থাপন করা হয়। বেসরকারিকরণের আওতায় এটি এখন হাইডেলবার্গ সিমেন্টের কারখানা। তবে নব্বই দশকের দিকে দেশে সিমেন্টের চাহিদার ৯৫ শতাংশ আমদানি করা হতো। ১৯৯২ সালে দেশীয় উদ্যোক্তাদের মালিকানায় দেশে প্রথম বেসরকারি খাতে মেঘনা সিমেন্ট মিল স্থাপন করে বসুন্ধরা গ্রুপ। এ মিলে উৎপাদিত কিং ব্র্যান্ড সিমেন্ট বেশ পরিচিতি লাভ করে। তারা পরে আরও সিমেন্ট শিল্প খাতে বিনিয়োগ করেছে। ২০০০ সালের পর মেট্রোসেম, ক্রাউন, প্রিমিয়ার, শাহ, ফ্রেশ, আকিজ, আনোয়ার, আমান, মীর সিমেন্টসহ একাধিক কোম্পানি এ খাতে বিনিয়োগ করে। সিমেন্ট উৎপাদনকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে সিমেন্ট সরবরাহ করছে। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেলসহ সব বড় প্রকল্পে দেশি সিমেন্ট ব্যবহার হচ্ছে। বসুন্ধরা, কিং ব্র্যান্ড, প্রিমিয়ারসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। এ খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, সিমেন্টের মূল কাঁচামাল ক্লিংকার, জিপসাম ও ফ্লাই অ্যাশ। যা পুরোপুরি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। স্থানীয় পর্যায়ের কাঁচামাল খুব সামান্য। দেশীয় কোম্পানিগুলো চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে ক্লিংকার আমদানি করে। দেশের ছোট অনেক কারখানা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছে। এখন বেশি উৎপাদন করে ব্যয় কমাতে আধুনিক ভার্টিক্যাল রোলার মিল (ভিআরএম) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে সাম্প্রতিক সময়ে উৎপাদন অনেক বেড়েছে।
গ্লোবাল সিমেন্ট প্রতিবেদনের তথ্য
২০১৬ সালে বিশ্বে ৪১২ কোটি ৯০ লাখ টন সিমেন্ট ব্যবহার হয়। তখন উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৬১৩ কোটি ৮০ লাখ টন। বাজারের আকার ছিল ৩৯৫ বিলিয়ন ডলার বা ৩৩ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এ আকারের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ২০তম। দেশভিত্তিক সিমেন্ট ব্যবহারে শীর্ষে রয়েছে চীন। এর পরের অবস্থান ভারতের।
সম্ভাবনার বৈশ্বিক দিগন্ত
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনে জনপ্রতি ১ হাজার ৭০০ কেজি সিমেন্টের ব্যবহার হয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়ায় তা ছিল ১ হাজার ২৫০ কেজি, মালয়েশিয়ায় ৮০০ কেজি। ওই বছর বিশ্বে জনপ্রতি ৫৬৩ কেজি সিমেন্ট ব্যবহার হয়েছিল। এ হিসাবে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে, ২০২০ সালে ব্যবহারের পরিমাণ ছিল জনপ্রতি ১৮২ কেজি। এমনকি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থেকেও ভারতে জনপ্রতি ৩১২ কেজি এবং মিয়ানমারে ২৭০ কেজি সিমেন্ট ব্যবহার হচ্ছে। ব্যবহারে পিছিয়ে থাকলেও উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাকা জোরেশোরে সচল থাকায় দেশেও ক্রমে বাড়ছে সিমেন্টের ব্যবহার।
ভোক্তা কারা
মোট চাহিদার ৩৫ শতাংশের বেশি সরকার ব্যবহার করছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেড়েছে। এর পরে রয়েছে বেসরকারি খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। ৩৫ শতাংশের মতো ব্যবহার করছেন উদ্যোক্তারা। এর বাইরে দেশব্যাপী ব্যক্তি উদ্যোগে দালানকোঠা নির্মাণে বাকি প্রায় ৩০ শতাংশ চাহিদা তৈরি হচ্ছে।
দেশীয় কোম্পানি
বর্তমানে ছোট-বড় ৪২টি সিমেন্ট কোম্পানি রয়েছে। তবে উৎপাদনে আছে ৩৫টি। এর সবগুলোর স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা বছরে ৫ কোটি ৮০ লাখ টন। যদিও চাহিদা কম থাকার কারণে এর ৫৭ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে। অথচ দুই দশক আগেও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। নব্বইয়ের দশকের শুরুতেও চাহিদার ৯৫ ভাগ মিটত আমদানি করা সিমেন্ট দিয়ে। ১৯৯৫ সাল থেকে সরকারি নীতি প্রণোদনার পরই পাল্টাতে শুরু করে এ খাত।
বেড়েছে রপ্তানি
স্থানীয় পর্যায়ে সিমেন্ট উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানিও হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে যাচ্ছে বেশির ভাগ। এ ছাড়া মিয়ানমারেও যাচ্ছে কিছু। নতুন করে নেপাল ও ভুটানে সিমেন্ট রপ্তানির পরিকল্পনা করছে অনেক কোম্পানি। সম্প্রতি ভারতের সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলের বাজারে বাংলাদেশের সিমেন্টের বিশাল চাহিদা রয়েছে। বিপুল পরিমাণ সিমেন্ট সেখানে রপ্তানি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।