সোমবার, ১ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

অপার সম্ভাবনায় চ্যালেঞ্জ চোরাচালান

রুহুল আমিন রাসেল

অপার সম্ভাবনায় চ্যালেঞ্জ চোরাচালান

দেশে জুয়েলারি শিল্পের বিকাশে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সোনা চোরাচালান। অংশীজনরা বলছেন- সরকারি নীতি সহায়তার অভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না চোরাচালান। ব্যাপক আকারে গড়ে উঠছে না জুয়েলারি শিল্প-কারখানা। চোরাচালানের মাধ্যমে আসা অলংকার বা গহনায় সারা দেশ  সয়লাব। হাতে তৈরি সোনার গহনার কদর বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। ফলে রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। জুয়েলারি শিল্পে কারখানা স্থাপনে আসছে দেশি-বিদেশি নতুন বিনিয়োগ। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডার মতো উন্নত দেশে বাংলাদেশি গহনা রপ্তানির ব্যাপক চাহিদা থাকার তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন-বাজুস।

দেশের ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য সংগঠন বাজুসের সহসভাপতি ও সংগঠনটির ফরেন ট্রেড অ্যান্ড মার্কেট ডেভেলপমেন্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান বাদল চন্দ্র রায় গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের ভিশন ম্যানুফ্যাকচারিং।  এ লক্ষ্য অর্জনে আমরা এগোচ্ছি। বাংলাদেশের জুয়েলারি ব্যবসা দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের জিডিপিতে জুয়েলারি খাত অবদান রাখছে।  বাংলাদেশের জিডিপি যেটুকু উন্নতি করছে তার পেছনে জুয়েলারি ব্যবসা সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

বাজুস সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের গহনা পণ্য ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা ও কানাডার মতো উন্নত দেশগুলোতে রপ্তানির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের সোনার অলংকার তৈরির কারিগররা খুবই নিখুঁতভাবে গহনা তৈরি করেন। যা মেশিনে সম্ভব নয়। আবার হাতে তৈরি গহনায় স্বর্ণের পরিমাণও কম লাগে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে হাতে তৈরি স্বর্ণের গহনা রপ্তানিতে সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন। ভারত বিশ্ববাজারে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের স্বর্ণের গহনা রপ্তানি করছে।

এ প্রসঙ্গে বাজুসের সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাতে তৈরি স্বর্ণের গহনার অপরিসীম সম্ভাবনা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি আগ্রহ মধ্যপ্রাচ্যের। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন। তার দাবি- বাংলাদেশি দক্ষ কারিগরদের হাতে তৈরি স্বর্ণের গহনা রপ্তানি শুরু করতে পারলে, মাত্র এক বছরেই ভালো অবস্থানে যাবে জুয়েলারি ব্যবসা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে থাকা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি সুবিধা রপ্তানিতে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আরেকটি বিষয় হলো- ২১ ক্যারেটের স্বর্ণের গহনা তৈরিতে বাংলাদেশি কারিগররা খুবই দক্ষ। যার চাহিদা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ববাজারে ব্যাপক। এ সুযোগ ও বিশাল রপ্তানি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে স্বর্ণের গহনা তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে নীতি সহায়তা দরকার।

বাজুস সূত্র জানায়, দেশের যে কোনো বৈধ অলংকার ব্যবসায়ী, তার নিজস্ব উৎস থেকে সর্বনিম্ন ৮ শতাংশ মূল্য সংযোজন করে বিদেশে রপ্তানি করতে পারবেন। একজন বৈধ অলংকার ব্যবসায়ী সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত, তাই তার প্রতিষ্ঠানের সব অলংকার বৈধ বলে বিবেচিত। ওই ৮ শতাংশ মূল্য সংযোজি বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনবেন। বাকি ৯২ শতাংশ পুনঃ আমদানি করে তা প্রতিস্থাপন করতে হবে।

সরকারি তথ্য বলছে- দেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ৪০ টন স্বর্ণ প্রয়োজন। যা বর্তমানে বিদেশফেরত প্রবাসীদের কাছ থেকে, কিছুটা আমদানি করে ও পুরনো স্বর্ণ গলিয়ে সংগ্রহ করা হয়। এর আগে বিভিন্ন সময় বাজেয়াপ্ত স্বর্ণ বিক্রি করা হলেও ২০০৮ সালের জুনের পর কোনো নিলাম হয়নি।

সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে স্থায়ী, অস্থায়ী ও রিজার্ভ খাত মিলে মোট স্বর্ণ জমা রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৩৬০ কেজি। এর মধ্যে ২ হাজার ৯০০ কেজির বেশি আছে অস্থায়ী খাতে। আর স্থায়ী খাতে আছে ১৫৯ কেজি। এই দুই খাত মিলে রৌপ্য জমা আছে ৫ হাজার ৪৬৪ কেজি। আন্তর্জাতিক বাজার দরে স্থায়ী ও অস্থায়ী খাতে পড়ে থাকা স্বর্ণ ও রোপ্যের দাম প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। মূলত আটক স্বর্ণ ও রৌপ্যের মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা ও দীর্ঘদিন নিলাম না হওয়ায় এসব স্বর্ণ ও রোপ্য দেশের অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে ২ হাজার ২৩০ কেজি স্বর্ণের বার নেওয়া হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের বুলিয়ন ভল্টে মোট স্বর্ণ জমা আছে ৫ হাজার ৩৫৯ কেজি ৬৯৫ গ্রাম। এর মধ্যে অস্থায়ী খাতে (মামলাধীন) জমা স্বর্ণের পরিমাণ ২ হাজার ৯০০ কেজি ৪৭৬ গ্রাম। মামলা নিষ্পত্তির পর স্থায়ী খাতে জমা আছে ১৫৯ কেজি ৩৯৫ গ্রাম। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে নেওয়া স্বর্ণের পরিমাণ ২ হাজার ২২৯ কেজি ৮২৩ গ্রাম। জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি স্থায়ী খাতে নেওয়া ৪৫৬ কেজি ওজনের ৩ হাজার ২৪৬ পিস স্বর্ণের বার কিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে যোগ করা হয়, যার আর্থিক মূল্য ছিল ১৪১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

জানা গেছে, বিভিন্ন সময় জব্দ ও মামলা নিষ্পত্তির পর ভল্টে রক্ষিত স্বর্ণ বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বৈধ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই স্বর্ণ কিনতে পারবেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন দফতরে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। স্বর্ণের ডিলার নিয়োগের আগে মধ্যবর্তী ব্যবস্থা হিসেবে ভল্টে রক্ষিত জব্দ করা ও নিষ্পত্তি হওয়া স্বর্ণ বিক্রি করতে চারটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো- এক. আন্তর্জাতিক বাজারের অর্থাৎ লন্ডন বুলিয়ন মার্কেট অ্যাসোসিয়েশন- এলবিএমএ’র সঙ্গে সংগতি রেখে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কেনা স্বর্ণ অন্যান্য ব্যবসায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন একসঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে কমিশন নির্ধারণ করবে। দুই. বিএসটিআই  স্বর্ণের মান যাচাইয়ে ল্যাবরেটরি আপগ্রেডেশনের ব্যবস্থা নেবে। বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড-বিএবি আন্তর্জাতিক অ্যাক্রিডিটেশন গ্রহণের ব্যবস্থা নেবে। তিন. স্বর্ণের মান যাচাই করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলা গোল্ডকে বিএবি সনদ নিতে হবে। চার. ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার আলোকে ভোক্তা অধিদফতরের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে।

এদিকে সারা দেশের জল, স্থল ও আকাশপথে বেপরোয়া হয়ে উঠছে স্বর্ণ চোরাচালান। সূত্র বলছে- স্বর্ণ চোরাচালান বাড়ার নেপথ্যে শুল্ক ফাঁকি। চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসা স্বর্ণ অধিকাংশই পাচার হয় প্রতিবেশী ভারতে। দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা চোরাচালানের স্বর্ণ নিরাপদে সীমান্তপথে পাচার হচ্ছে।

এর আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর চেয়ারম্যানকে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়-  রেমিট্যান্স কমার পেছনে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দায়ী। ব্যাগেজ রুলের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিন্ডিকেট প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে এর পরিবর্তে সোনার অলঙ্কার ও বার দিচ্ছে। সেই সিন্ডিকেটের এ দেশীয় এজেন্টদের কাছে হস্তান্তর করেই প্রবাসীরা টাকা পেয়ে যাচ্ছে। মূলত চক্রটি বাংলাদেশে আগত প্রবাসীদের বাহক হিসেবে ব্যবহার করছে। এ কাজে উৎসাহিত করতে নানা প্রলোভন দেওয়া হয়। কখনো বিমান টিকিট, কখনো কমিশন, আবার কখনো বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্যের চেয়ে বাড়তি টাকা দেওয়া হয়।

ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ব্যাগেজ রুল সংশোধনের সুপারিশ করে বলা হয়- ব্যাগেজ রুলের সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রায় রেমিট্যান্স না এনে স্বর্ণ নিয়ে আসার ফলে অফিশিয়াল চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা কমছে বা কমতে পারে। অন্যদিকে স্বর্ণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে থাকে। উভয় ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ।

ব্যাগেজ রুল অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি বিদেশ থেকে দেশে আসার সময় ১০০ গ্রাম (সাড়ে ৮ ভরি) ওজনের স্বর্ণের অলংকার আনতে পারেন, এক্ষেত্রে শুল্ক-কর দিতে হয় না। এ ছাড়াও ২৩৪ গ্রাম (২০ ভরি) ওজনের স্বর্ণের বার আনতে পারেন, এক্ষেত্রে ভরিপ্রতি ২ হাজার টাকা করে শুল্ক দিতে হয়। সে অনুযায়ী স্বর্ণের বার আনলে ৪০ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হয়। ১০০ গ্রামের (সাড়ে ৮ ভরি) অলংকার আনার ক্ষেত্রে ব্যাগেজ রুলে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা না থাকায়, অনেক যাত্রী শুল্ক-কর দিয়ে বাড়তি অলংকার সঙ্গে করে নিয়ে আসছেন।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে স্বর্ণ আনতে প্রবাসে কর্মরত একটি সংঘবদ্ধ চক্র বা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। দেশে ফেরত আসার সময় প্রবাসী শ্রমিকরা ক্যারিয়ার গ্রুপ হিসেবে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে স্বর্ণ বহন করে। অথবা সিন্ডিকেট প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার তুলনামূলক বেশি দামে কিনে ওই দেশেই  স্বর্ণের দেনা পরিশোধ করে এবং বাড়তি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ব্যাগেজ রুলের আওতায় স্বর্ণ নিয়ে দেশে ফিরতে উৎসাহিত করছে।

ওই প্রতিবেদনে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার কারণ ব্যাখ্যা করে বলা হয়- আন্তর্জাতিক বাজারে ২৪ ক্যারেট প্রতিভরি স্বর্ণের দাম দেশভেদে ৫৮ থেকে ৬৫ হাজার টাকা।  বিমানবন্দরে ২ হাজার টাকা শুল্ক দেওয়ার পর স্থানীয় বাজারে সেই সোনা প্রতি ভরি ৭২ থেকে ৭৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে প্রতি ভরিতে মুনাফা হচ্ছে প্রায় ১০-১৫ হাজার টাকা।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়- বৈদেশিক মুদ্রায় রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে স্বর্ণ আনলে প্রবাসীরা কয়েকভাবে লাভবান হচ্ছেন। প্রথমত. কম দামে স্বর্ণ এনে বেশি দামে বিক্রি করছেন। দ্বিতীয়ত. বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে ব্যাংকের চেয়ে বেশি দাম পাচ্ছে। তৃতীয়ত, রেমিট্যান্সের অর্থ পেতে প্রবাসীকে কোনো খরচ করতে হচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর