সোমবার, ১ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

নকশা ও মানে অনন্য আপন জুয়েলার্স

গুলজার আহমেদ, কর্ণধার, আপন জুয়েলার্স, ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)

জয়শ্রী ভাদুড়ী

নকশা ও মানে অনন্য আপন জুয়েলার্স

আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার ও বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) ভাইস প্রেসিডেন্ট গুলজার আহমেদ বলেছেন, ১৯৮২ সালে মৌচাক থেকে যাত্রা শুরু করে আপন জুয়েলার্স। সেসময় ঢাকা শহরে খুব একটা স্বর্ণের দোকান ছিল না। তখন আমরা গহনার ব্যবসা শুরু করি। আমাদের পূর্ব পুরুষরা জুয়েলারি ব্যবসায় জড়িত ছিলেন না। আমার বাবা আবদুল আহাদ প্রবাসে থাকতেন। বিদেশ থেকে ফিরে তিনি কিছুদিন বিভিন্ন ব্যবসা করে এক সময় জুয়েলারি ব্যবসার গোড়াপত্তন করেন। আমরা তিন ভাই; মেজভাই দিলদার আহমেদ এবং ছোটভাই আজাদ আহমেদ। প্রথমে আমি বাবার সঙ্গে ব্যবসা শুরু করি এরপর আমার ছোটভাই দিলদার এসে যোগ দেয়। আমরা একই ব্রাঞ্চে বাবার সঙ্গে দুই ভাই বসতাম। তখন গহনার দোকান বেশ জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ওই সময় বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশের মার্কেট খুব জমজমাট ছিল। জুয়েলারি ব্যবসা বাড়াতে আমরা ১৯৮৫ সালের দিকে ওই মার্কেটে একটা দোকান নিই। মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় ১৯৮৬ সালে উদ্বোধন করা দোকানটি আপন জুয়েলার্সের দ্বিতীয় ব্রাঞ্চ। আমরা শুরু থেকেই পণ্যের গুণগত মান সঠিক রাখতে খুব সচেতন। স্বর্ণের মান, দাম, গ্রাহক সন্তুষ্টিই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এর প্রায় তিন বছর পর ধানমন্ডির রাইফেল স্কয়ার বর্তমানের সীমান্ত স্কয়ারে আরেকটা ব্রাঞ্চ করি। এই ব্রাঞ্চ আমার ভাই দিলদার আহমেদ পরিচালনা করতেন।

ব্যবসা এগিয়ে নেওয়ার গল্প বলতে গিয়ে বিশিষ্ট এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, এরপর গুলশানে ডিসিসি মার্কেটে দোকান করি। তখন গুলশানে কোনো গহনার দোকান ছিল না। আমি জাপান দূতাবাসে ভিসা জমা দিতে এসে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে ডিসিসি মার্কেটে দোকানটা পছন্দ করে কিনে ফেলি। এরপর গুলশানে আমাদের ব্রাঞ্চ খোলা হয়। ততদিনে আমরা তিন ভাই ব্যবসায় নেমে পড়েছি। বায়তুল মোকাররম মার্কেটের নিচ তলায় আরেকটা ব্রাঞ্চ খোলা হয়। ওটাতে আমার ছোটভাই আজাদ আহমেদ বসত। গুলশানে ব্রাঞ্চ চালু করার পর আমার বাবা গুলশান ব্রাঞ্চে বসতেন। গুলশান বিলাসবহুল এলাকায় ব্যবসা বেশ জমে উঠল। বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিদেশি নাগরিকরা এখানে কেনাকাটার জন্য আসতেন। সার্বিক দিক বিবেচনায় এনে ২০১১ সালে আমরা গুলশান এভিনিউতে সাড়ে ছয় হাজার স্কয়ার ফুটের শোরুম করি। এ ব্রাঞ্চটা জুয়েলারি জগতে পরিবর্তন নিয়ে আসে। এরপর উত্তরাতে আমরা ব্রাঞ্চ খুলেছি। এটা আমার ভাই দিলদার আহমেদ এবং তার ছেলে শাফাত আহমেদ পরিচালনা করছেন। ক্রেতাদের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে ছয় মাস আগে মিরপুরে আমরা আপন জুয়েলার্সের অষ্টম ব্রাঞ্চ চালু করেছি। আমরা ঢাকা শহরের সব এলাকার ক্রেতাদের কেনাকাটার প্রয়োজনীয়তা চিন্তা করে চারদিকে ব্রাঞ্চ করেছি। আমার ছোটভাই দিলদার আহমেদ ২০০৬ সালে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছে। এর আগে স্বর্ণের মান যাচাই করা হতো না। সে দায়িত্ব নিয়ে স্বর্ণের মান নিশ্চিত করায় জোর দেয়। যেমন; ২১ ক্যারেট বিক্রি করলে ক্রেতাকে ২১ ক্যারেট বলতে হবে। আমরা আটটি ব্রাঞ্চে কোয়ালিটি কন্ট্রোল মেশিন রেখেছি। ক্রেতা সামনে দাঁড়িয়ে পণ্যের মান পরীক্ষা করে কিনতে পারবে। পণ্য বিক্রির পরও আমরা ক্রেতাকে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। পণ্য পরিবর্তন করে দেওয়া, পণ্য বিক্রি করলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের টাকা বুঝিয়ে দিয়ে থাকি। ক্রেতা সরাসরি অভিযোগ করলে তা গ্রহণ করে সমাধান করি। আমার মেয়ে কানিজ ফাতেমা লন্ডন থেকে পড়াশোনা করে ফিরে  আমার সঙ্গে গুলশান এভিনিউ ব্রাঞ্চ পরিচালনা করছে।

আপন জুয়েলার্সের নকশায় অনন্যতার বিষয়ে গুলজার আহমেদ বলেন, আমরা গহনার নকশায় সবসময় নতুনত্ব দেওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের দেশে ডিজাইনার কম। বাইরে থেকে ডিজাইন সংগ্রহ করে স্থানীয়ভাবে কারিগর দিয়ে গহনা তৈরি করতে হয়। আমার আরেক মেয়ে কানিজ শানজিদা। সে আর্কিটেক্ট, যুক্তরাজ্যে লেখাপড়া করে। সে অনেক ডিজাইন তৈরি করে আমাদের পাঠায়। আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করি। দেশের স্বর্ণের গহনা বাইরে রপ্তানি হোক এটা আমরা চাই। দুই বছর আগে আমাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। প্রথম ধাপে কিছু স্বর্ণ রপ্তানি হয়েছিল। কিন্তু ট্যাক্সসহ আনুষঙ্গিক চার্জ যোগ করে রপ্তানিকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। রপ্তানিকারকরা চাইছে কিন্তু অনুমতি না থাকায় স্বর্ণ রপ্তানি করা যাচ্ছে না। আমরা যেসব স্বর্ণ নিয়ে কাজ করি তার বেশির ভাগই রিসাইকেল করা।

স্বর্ণের বাজারে ক্রেতার চাহিদা বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা প্রথম যখন মৌচাক মার্কেটে দোকান খুলি তখন ৩ হাজার ৩০০ টাকা স্বর্ণের ভরি ছিল। সে সময় আমাদের দোকানে প্রচুর ক্রেতা ছিল। এখন তো প্রায় ৭৮ হাজার টাকা ভরি স্বর্ণ। দাম বেড়েছে কিন্তু ক্রেতা কমেনি। ভালো মানের পণ্য এবং সেবা দিলে শহর, গ্রামগঞ্জ যেখানেই হোক ব্যবসা চলবে। ভালো মানের পণ্য এবং সেবা দিতে না পারলে কখনো ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ব্যবসা মানেই চ্যালেঞ্জ। ক্রেতার পছন্দকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাকে খুশি করেই গহনা বিক্রি করতে হবে। ক্রেতার পছন্দ, কেমন দামের পণ্য চাইছে সেগুলোকে মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ দাম দিয়ে ক্রেতা পণ্য কিনবে। নতুন গহনা সামনে রাখতে হবে, পুরনো গহনা কম দেখিয়ে ক্রেতার আগ্রহ ধরে রাখতে হবে। এভাবে ব্যবসাটাকে নিজের অনুকূলে নিতে হবে। ঢাকার বাইরে আমাদের গহনার চাহিদা আছে। স্বর্ণ ভারী জিনিস হওয়ায় এটাকে বহন করা, মান নিশ্চিত করা একটু কঠিন হয়ে যায়। তাই এখনই ঢাকার বাইরে ব্রাঞ্চ না খুললেও ভবিষ্যতে ইচ্ছা আছে।

বাজুসের ভাইস প্রেসিডেন্ট গুলজার আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) সভাপতি সায়েম সোবহান আনভীর দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বর্ণের বাজারে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা শুধু স্বর্ণের বাজার কত হবে এটা নির্ধারণ করতেন। কোয়ালিটি কন্ট্রোল নিয়ে কিছুটা ভাবতেন। এভাবে বাজার সীমাবদ্ধ রাখায় মাত্র ১৫ হাজার সদস্য ছিল সংগঠনে। নতুন সভাপতি দায়িত্ব নিয়ে চিন্তা করলেন ব্যবসা করতে হলে সদস্য বাড়াতে হবে। এখন বাজুসের সদস্য ৪০০০০-৪৫০০০ জন হয়েছে। নিজেদের সমস্যা, সম্ভাবনা নিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হয় সংগঠনে। সমিতি থেকে ব্যবসায়ীরা যেন সুফল পান সে লক্ষ্যে তিনি কাজ করছেন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বর্ণের দাম কমেছে। কিন্তু ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্বর্ণের দাম ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। কিন্তু বাজুস সভাপতি দাম বাড়ানোর পক্ষে নয়। তাঁর বক্তব্য আপনাদের কাছে যতক্ষণ স্টক আছে ততক্ষণ ক্রেতাকে কম দামে পণ্য দেওয়ার চেষ্টা করবেন। ক্রেতা যেন বিদেশমুখী না হয়।  বাজুস সভাপতির রিফাইনারি কোম্পানি থেকে আগামী বছর স্বর্ণ এলে আমরা দেশব্যাপী আরও বড় পরিসরে স্বর্ণালঙ্কারের ব্যবসা পরিচালনা করতে পারব। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমরা স্বর্ণ রপ্তানি করারও আশা করছি।

বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনা বিষয়ে তিনি বলেন, বিদেশি ক্রেতাদের কাছে আমাদের গহনার অনেক কদর। আমি জাপান, বাহরাইন, দুবাইতে জুয়েলারি মেলায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। তখন দেখেছি, আমাদের গহনা হালকা হওয়ায় ক্রেতারা খুব পছন্দ করেন। ভারত থেকে যে স্বর্ণালঙ্কার তৈরি করা হয় তা যদি পাঁচ ভরি হয়, একই ডিজাইনে অলঙ্কার আমাদের দেশের কারিগররা তিন ভরিতে নিখুঁতভাবে বানাতে পারেন। স্বর্ণকারদের হাতের দক্ষতায় এটা সম্ভব হয়। তখন আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় রপ্তানি করতে পারিনি। আমরা এখন রপ্তানির ব্যাপারে আশাবাদী। আমরা একটা চেইন ফ্যাক্টরি করেছি। আমার ভাই আজাদ আহমেদ বেঙ্গল ডায়মন্ড নামে একটা ফ্যাক্টরি দিয়েছে। এখানে ডায়মন্ড, স্বর্ণ দিয়ে কিছু গহনা বানানোর প্রক্রিয়া চলছে, পরে রপ্তানি করব। কিছু ডায়মন্ড বিদেশ থেকে এনে এখানে কাটিং করছি। আগামী মাসে আমরা এসজিএল নামে একটি ব্র্যান্ড চালু করছি। এখানে যে কোনো ধরনের হীরা নিয়ে এসে টেস্ট করা যাবে। এটা বিশ্ব মানের ল্যাব। ডায়মন্ড ব্যবহারকারীরা মান যাচাই করে নিতে পারবেন। এখান থেকে যে সার্টিফিকেট আসবে তা বিশ্বজুড়ে কার্যকর হবে। এই লোগো দেখে কিনলে কেউ প্রতারিত হবে না। আমরা এখন স্থানীয়ভাবে বেচাকেনা করছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ব্যবসায় যোগ দিয়েছে। আমাদের আশা আগামীতে রপ্তানি করতে পারব। আগে গার্মেন্ট প্রোডাক্ট রপ্তানি হতে দেখে আমরা অবাক হতাম। কিন্তু এটা এখন অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এভাবে একদিন বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ এবং স্বর্ণালঙ্কার বিদেশে রপ্তানি হবে। দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে এই খাত অবদান রাখবে।

সর্বশেষ খবর