বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

দেশে টেলিভিশনের বিশাল বাজার

► বাজার প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার ► অ্যান্ড্রয়েড ও ভয়েস কন্ট্রোল টিভির চাহিদা বাড়ছে ► এ বছর মন্দার কারণে বিক্রি কিছুটা কমেছে

মানিক মুনতাসির

দেশে টেলিভিশনের বিশাল বাজার

দুয়ারে কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপ ফুটবল। বিশ্বের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার সুযোগ পাবেন এই মৌসুমে। আর বিশ্বের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি। ফলে বাকি সবাই খেলা দেখবেন টিভিসেট কম্পিউটার, ট্যাব, নোটপ্যাড মোবাইল বা যে কোনো ধরনের ইলেকট্র্রনিক্স ডিভাইসের মাধ্যমে। তবে অধিকাংশই দেখবেন টিভির মাধ্যমে। বাংলাদেশেও চলছে বিশ্বকাপের ঝড়। খেলা দেখার জন্য নতুন নতুন টিভি কিনছে মানুষ।  জমে উঠেছে টেলিভিশনের বাজার...

 

দুয়ারে কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপ ফুটবল। এটি একটি বৈশ্বিক উৎসবের মতো। বিশ্বের ৩২টি দেশ এই আসরে অংশগ্রহণ করলেও ফিফার সদস্য দেশ রয়েছে ২১১টি। এর প্রায় সব দেশই বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে অংশ নেয়। দীর্ঘ বাছাই প্রক্রিয়া শেষে ৩২টি দল মূল আসরে প্রতিযোগিতা করে মাসব্যাপী। বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু খেলা নয়, এটা একটা বিরাট বিনোদন। আয়োজক দেশের জন্য বিশাল এক পর্যটন ব্যবসা। এ ছাড়া এয়ারলাইনস, খাদ্য, নানা রকম পোশাক, জার্সি, বুট, বলের বাজারেও রমরমা ব্যবসা হয় এই আসরের মাসে। এ ছাড়া বাম্পার ব্যবসা হয় টেলিভিশনের বাজারেও। সবার পক্ষে মাঠে গিয়ে খেলা দেখা সম্ভব হয় না। বিশ্বের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার সুযোগ পাবেন এই মৌসুমে। আর বিশ্বের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি। ফলে বাকি সবাই খেলা দেখবেন টিভিসেট কম্পিউটার, ট্যাব, নোটপ্যাড মোবাইল বা যে কোনো ধরনের ইলেকট্র্রনিক্স ডিভাইসের মাধ্যমে। তবে অধিকাংশই দেখবেন টিভির মাধ্যমে। একটা সময় ছিল সাদাকালো টেলিভিশনে দল বেঁধে খেলা দেখতে হতো। বড় পর্দা লাগিয়ে প্রজেক্টর বসিয়ে খেলা দেখার আয়োজন করা হতো। এখনো সে ধারা রয়েছে। তবে আপডেটও হয়েছে প্রযুক্তির ধারা। বড় বড় এলইডি টিভি কিং বা স্ক্রিন বসিয়ে দল বেঁধে আনন্দঘন পরিবেশে খেলা দেখা হয়।

গ্লোবালাইজেশন আর আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ এখন ঝকঝকে রঙিন দুনিয়ার মতোই খেলা দেখেন রঙিন পর্দায়। যা বাস্তবের চেয়ে দেখতে সুন্দর। বড় বড় টিভি শোভা পায় ড্রয়িং রুমে, অফিসে, ক্লাবে কিংবা খোলা মাঠেও।

বাংলাদেশেও চলছে বিশ্বকাপের ঝড়। খেলা দেখার জন্য নতুন নতুন টিভি কিনছে মানুষ। জমে উঠেছে টেলিভিশনের বাজার। তবে অন্যবারের তুলনায় এ বছর বিক্রির পরিমাণ কিছুটা কম। কেননা বিশ্ব এখন খুবই কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। অর্থনৈতিক মন্দা আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। ফলে আগের বারের তুলনায় এ বছর টেলিভিশন বিক্রিতে কিছুটা ছন্দপতন ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারপরও মানুষ মিলেমিশে খেলা দেখতে নতুন নতুন টিভি কিনছেন।

ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বিক্রেতারা বলছেন, ডলার সংকট ও যন্ত্রাংশের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায় সব ধরনের টিভির দাম ৭-১০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া এসব পণ্য আমদানিতেও অনেকটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে সরকার। ফলে বিদেশির পাশাপাশি দেশীয় ব্র্যান্ডের দেশীয় টিভি কোম্পানিগুলোর বিক্রি বেড়েছে। এসব কোম্পানির জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত ক্রেতারাও আছেন চাপে। সে কারণে পর পর দুটি বিশ্বকাপ থাকলেও আশানুরূপ বিক্রি শুরু হয়নি। তবে ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হলে বিক্রি কিছুটা বাড়বে বলে তাঁদের প্রত্যাশা।

নইম হোসেন ভুইয়া নামের একজন বলেন, ছোটবেলায় সত্তর আশির দশকে সাদাকালো টিভিতে খেলা দেখতাম। আর এখন তো সারা দুনিয়াই রঙিন। ওসব সাদাকালো টিভি এখন হারিয়ে গেছে। জায়গা করে নিয়েছে রঙিন ঝকঝককে বড় বড় টেলিভিশন।

জানা যায়, বর্তমানে দেশে প্রতি বছর ১৫ লাখের মতো নতুন টেলিভিশন বিক্রি হয়। দেশে এখন বিক্রীত টেলিভিশনের মধ্যে অধিকাংশই এলইডি প্রযুক্তির। পাশাপাশি স্মার্ট টিভির চাহিদা বাড়ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে মোট বিক্রি হওয়া ইলেকট্রনিক্স পণ্যের মধ্যে টেলিভিশনের বাজার প্রায় ৩০ শতাংশ। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের টেলিভিশনের বাজার বেড়ে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে। যা বর্তমানে ৭ থেকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার।

এ প্রসঙ্গে ইলেকট্রোমার্ট লিমিটেডের পরিচালক নুরুল আফসার বলেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে টেলিভিশন বিক্রি কিছুটা বেড়েছে। তবে আগের ফুটবল বিশ্বকাপ মৌসুমগুলোর তুলনায় কম।

মাইওয়ান গ্রুপের মিনিস্টার হাইটেক পার্ক লিমিটেডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক খান রাজ বলেন, বাংলাদেশের টেলিভিশন বাজারে এখন স্থানীয় উৎপাদকদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু কিছু বাধা রয়েই গেছে। টেলিভিশন শিল্প খাতের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে এর আমদানি পর্যায়ে কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের ওপর আরোপিত ভ্যাট এবং ট্যাক্স যা সহজীকরণ করলে এই খাত আরও দ্রুত বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি মনে করেন। এবারের বিশ্বকাপ একটা খারাপ সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দেশীয় টিভির বাজারে আমাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আমরা ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই পণ্য সরবরাহ করে থাকি। বিশেষ করে সায়শ্রী মূল্যে উন্নত মানের আধুনিক প্রযুক্তিগত পণ্য পৌঁছে দিতে চেষ্টা করে মিনিস্টার। আমাদের গ্রাহক ফিডব্যাকও বেশি সন্তোষজনক। জানা গেছে, গত এক যুগে বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তি শিল্প খাতের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে। যার মূলে রয়েছে বর্তমান সরকারের গৃহীত শিল্পবান্ধব বিভিন্ন নীতিমালা, শতভাগ বিদ্যুতায়ন এবং এ খাতের উদ্যোক্তাদের দেওয়া নানান সুবিধা। সরকারের এসব শিল্পমুখী নীতি এবং উন্নয়নের ফলে দেশের ইলেকট্রনিক্স খাতে বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। যেখানে আগে এ খাত ছিল পুরোটাই আমদানিনির্ভর।

এ প্রসঙ্গে এম এ রাজ্জাক খান রাজ বলেন, মানুষের ভালোবাসা ও আস্থার জায়গাকে কেন্দ্র করে দেশের সেরা ব্র্যান্ড হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মিনিস্টার মাইওয়ান গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকে এখন অবধি আমরা সব সময় গ্রাহককে সর্বোত্তক প্রোডাক্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছি, তারাও আমাদের সেভাবে ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের ভালোবাসা সব সময় মিনিস্টারের পাশে থাকবে বলেই আশাবাদী।

বর্তমানে বাজারে মিনিস্টার, ওয়ালটন, স্যামসাং, সনি র‌্যাংগস, এলজি, সিঙ্গার, ভিশন, যমুনা, কনকা ইত্যাদি ব্র্যান্ডের টিভি জনপ্রিয়। টিভির বাজারে প্রায় ৭০ শতাংশ দেশীয় কোম্পানির দখলে। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোও খরচ কমিয়ে বাজার ধরতে দেশে কারখানা স্থাপন করছে। এ খাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশীয় এ শিল্পের বিকাশের ফলে আমদানি কমায় সাশ্রয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার। যার একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে।

ব্র্যান্ড ও দরদাম : দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের টিভির বিক্রি শুরু ১৪ ইঞ্চি থেকে, যেটির দাম ৯-১০ হাজার টাকা। ১৯ ইঞ্চি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, ২৪ ইঞ্চি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, ৩২ ইঞ্চি স্মার্ট টিভি ২২ থেকে ৩০ হাজার টাকা, ৪২ ইঞ্চি টিভি ৪৬ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠার অল্প দিনের মধ্যেই এসব দেশীয় কোম্পানি দর্শক ও গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে বেশ এগিয়ে গেছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সাইজের টেলিভিশন রয়েছে-সিঙ্গার, এলজি, ট্রান্সটেক, ওয়ালটন, প্যানাসনিক, কনকা ও হাইকো, হায়ার, ভিসতা, যমুনা। এসব কোম্পানির সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ লক্ষাধিক টাকা দামের বিভিন্ন সাইজ ও মানের টেলিভিশন রয়েছে বাজারে।  এসব দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের টেলিভিশন কেনায় অনেকে কিস্তির সুবিধাও দিয়ে থাকে।

সর্বশেষ খবর