সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

লুঙ্গি-গামছা ও বাঁশ

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

লুঙ্গি-গামছা ও বাঁশ

বৈশাখ এলেই ঢাকার রাজপথে লুঙ্গি-গামছা গায়ে শহুরে মানুষদের প্রতি নজর পড়ে অনেকের। আর চারুকলায় বাঁশের কঞ্চি কেটে বানানো মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য বিভিন্ন ফুল, পশু-পাখির অবয়ব আর বাঁশের মাথায় মুখোশ চোখে পড়ে। লুঙ্গি-গামছা আর বাঁশ নিয়ে প্রবল বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন একদল বিদেশি গবেষক। একটি উন্নয়ন সংস্থার হয়ে সমীক্ষা চালাতে গিয়ে চিরায়ত গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তরে তারা ঘুরেছেন বেশকিছু দিন। কাজ শেষে দেশে ফেরার আগে এক হালকা আড্ডায় তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এ দেশের কোন দিকটি তাদের বেশি আকৃষ্ট করেছে। অতি সাধারণ প্রশ্নের একটা গতানুগতিক উত্তরই আশা করেছিল উপস্থিত সবাই। পয়লা বৈশাখ-পরবর্তী ওই হালকা আড্ডায় কোনো গুরুগম্ভীর উত্তর না দিয়ে হালকা মেজাজেই উত্তর দিলেন তারা, যা হয়তো অপ্রত্যাশিত ছিল অনেকের কাছে।

 

ম্যাজিক পোশাক

একজন বিদেশির দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু হলো লুঙ্গি নামের একটি পোশাক। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, দেহের নিম্নাংশ ঢাকার জন্য যে কোনো পোশাক পরতে বা শরীরে জড়িয়ে রাখতে কোনো না কোনো কিছুর সাহায্য প্রয়োজন। যেমন পায়জামা পরতে ফিতা বা ইলাস্টিক লাগে, প্যান্ট পরতে বোতাম, হুক বা বেল্ট লাগে, বিশেষ প্রয়োজনে চেইন বা জিপার লাগে, কোনো কিছু রাখতে হলে পকেট লাগে ইত্যাদি। কিন্তু লুঙ্গির ক্ষেত্রে, না এসবের কিছুই লাগে না। ফিতা, ইলাস্টিক, বোতাম, হুক বা বেল্ট ছাড়াই দিব্যি লুঙ্গি নামের এই বিশেষ পোশাক পরে ফেলতে পারে বাঙালি পুরুষ। শুধু পরেই ক্ষান্ত হয় না, এই লুঙ্গিকে কখনো হাফপ্যান্ট বা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের মতো সংক্ষিপ্ত কিংবা সুইমিং কস্টিউমেরও অতি ছোট করে ফেলে চোখের নিমিষে। এই লুঙ্গি রাতে হয়ে যায় স্লিপিং গাউন। কখনো কখনো স্লিপিং গাউন আর গায়ের চাদরের কাজ একাই সামলায় এই বিশেষ পোশাক। পুকুরে লুঙ্গিতে বাতাস ঢুকিয়ে এক কিশোরকে সাঁতার কাটতে দেখে তাদের চক্ষু ছানাবড়া। এমন লাইফ সেভিং জ্যাকেটের কথা তারা ভাবতেও পারেননি। সহজ-সরল গ্রামবাসী তাদের জন্য পেয়ারা, বরই (কুল) ইত্যাদি নিয়ে হাজির হতো তাদের সামনে। বাঙালির এই চিরায়ত অতিথিপরায়ণ চরিত্র তাদের যতটা বিস্মিত করেছিল, তার চেয়ে বেশি বিস্ময় ঘটিয়েছিল যখন পরনের লুঙ্গিটিকে ব্যাগ বানিয়ে তারা অবলীলায় পেয়ারা আর বড়ই বহন করছিল। কোনো পকেট বা ওয়ালেট কিংবা মানিব্যাগ নয়। লুঙ্গির উপরি অংশে নিখুঁতভাবে টাকা-পয়সা গুঁজে রাখার বিষয়টি ছিল তাদের চোখে এক নতুন অভিজ্ঞতা। সব শুনে মনে হলো জয় হোক মেহনতি লুঙ্গির। লুঙ্গি আর গামছার সম্পর্কটা কী তা নিয়ে কোনো দিন গবেষণা হলেও হতে পারে। তবে লুঙ্গি-গামছা দুজনে দুজনার তা বলাই যায়।

 

গামছার কত বাহার

লুঙ্গির যখন এত গুণমান; তখন গামছা তো আর বাদ যেতে পারে না। শুরু হলো গামছার গুণগান। প্রথমেই লুঙ্গির সঙ্গে গামছার নিবিড় সম্পর্ক তুলে ধরে বিদেশির প্রশ্ন : লুঙ্গি তো একাই একশ। তারপরও মানুষ লুঙ্গির ওপর বেল্ট বা দড়ির মতো গামছা পেঁচায় কেন? আরও প্রশ্ন গামছা আসলে কী?

বৈশাখের গরমে কোনো বটতলায় শরীরের উপরের অংশ গামছায় ঢেকে রাখা পুরুষদের দেখে মনে হতে পারে গামছা হয়তো এক ধরনের হালকা পোশাক। আবার গোসলের পর গা মোছার দৃশ্য দেখলে মনে হয় গামছা আসলে তোয়ালে জাতীয় কিছু। আর গোসল শেষে কেশবতী বাঙালি রমণীর ভেজা চুলে জড়িয়ে গামছা হয়ে যায় হেয়ার ড্রায়ার। রমণীর দরদি হাতে মাঠের কৃষকের জন্য ডাল-ভাতের থালা-বাটি বন্দী হয় গামছা নামের টিফিন ক্যারিয়ার কিংবা ফুড কনটেইনারে। কৃষক আবার হাট থেকে কৃষানির জন্য অল্পস্বল্প চাল-ডাল, মুড়ি-মুড়কি যা-ই কিনুক, তা বহন করে গামছার পুঁটলিতে। তখন গামছা হয়ে যায় ব্যাগ। ব্যাগের পাশাপাশি র‌্যাগ বা ডাস্ট ক্লিনার কিংবা ধোয়া মোছার কাজে গামছার জুড়ি নেই। তা দামি পাজেরো জিপ হোক আর গ্রামের ভ্যানগাড়িই হোক; এককথায় বলা যায় গাড়ি যার যার; গামছা সবার। ফ্লোর কিংবা ফ্লোরে পড়ে থাকা জুতা থেকে ছাদে লাগানো সিলিং ফ্যান; গামছার বিচরণ সর্বত্র। ছাদ বা দেয়ালের গরম বৈদ্যুতিক বাতি খোলা কিংবা চুলার ওপর থেকে গরম পাতিল নামানো গামছার মতো হিট এবজারভার দ্বিতীয়টি নেই। বড় বড় অনুষ্ঠানের রান্নার জন্য বাবুর্চির চাহিদার তালিকায় নরম গামছার অবস্থান বেশ শক্ত। রান্নার সময় গরম ডেকচি ধরার পাশাপাশি ছাঁকনি বা ঢাকনার কাজে অদ্বিতীয় গামছা। বিয়ের আসরে বরের মাথায় যখন পাগড়ি, রোদে দাঁড়ানো বাবুর্চির মাথায় তখন গামছা। রোদ ঠেকানোর এমন হেট (ঐধঃ) আর কি কোথাও আছে? কনের মাথায় দামি রঙিন ওড়না। বহু হতাহতের ঘটনায় প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক কাজে লাগে গামছা।

 

বাঁশের জয়গান

বাঙালি আর বাঁশের সম্পর্ক বিদেশিদের নজর কাড়তেই পারে যেমনটা নজর কাড়ে বাঁশের বাঁশির সুর। বাড়িঘরের নির্মাণ কাজে বাঁশের ব্যবহার নতুন নয়, নতুন নয় নৌকার ছই, রিকশার হুড আর আকাশে ওড়া ঘুড্ডি বানাতে বাঁশের নানাবিধ ব্যবহার। জল, স্থল আর আকাশে তাই বাঁশের জয়জয়কার। তাই বলে নির্মাণ কাজে রডের বদলে বাঁশের ব্যবহার! এটা বোধহয় এ দেশেই সম্ভব। বিদেশি গবেষকরা এ খবর পড়ে বিস্মিত হতেই পারেন, কারণ তারা জানেন না নিজের স্বার্থে অন্যের মাথায় বাঁশ মারতে হাত কাঁপে না আমাদের অনেকের। একজন নেতার কথা শুনেছিলাম যিনি কারও উপকার করে টাকা-পয়সা তো নিতেনই না বরং উল্টো কিছু টাকা দিয়ে দিতেন। এর কারণ কাউকে জানতে দেননি কখনো। শেষ বয়সে মৃত্যুর আগে সবার অনুরোধে এই রহস্যের অবসান ঘটান তিনি। তার মতে, এটা হলো বাঁশ কেনার টাকা। কারণ তিনি নিশ্চিত যে, তার কাছ থেকে উপকার পাওয়া ব্যক্তি কোনো না কোনো দিন বেইমানি করে তার (এই নেতার) মাথায় বাঁশ মারবেই। যেহেতু বেইমান ব্যক্তিকে টাকা দেওয়া আছে সেহেতু মনে হবে আমার টাকায় কেনা বাঁশ আমার মাথায় পড়েছে, কেউ মারেনি। এই বাঁশ খেয়ে মরেও শান্তি। মরার পরও কবর দিতে বাঁশ লাগে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর