সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভুলোমন

আফরীন সুমু

ভুলোমন

আমি জানতাম ছেলেরা ভুলোমনের হয়। কেউ কম কেউ বেশি। কিন্তু বিয়ে করে জানলাম মেয়েরাও সাংঘাতিক ভুলোমনা হতে পারে। প্রথম ধাক্কাটা খেলাম বাসররাতে। আমি ঘরে ঢুকে দেখি, বউ ঘুমিয়ে পড়েছে। এ আর অস্বাভাবিক কী। সারাদিনে যা ধকল গেছে। তবু প্রথম বিয়ে বলে কথা। পারিবারিক বিয়ে হওয়ায় কৌতূহলটা কয়েকধাপ বেশি। আমি আস্তে করে ডাক দিলাম। বার দুইয়েক ডাকার পর বউ উঠে বসল। চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, বাবা এক গ্ল­াস পানি দেবে? একি কথা! এই মেয়ে কি উল্টাপাল্টা বলছে! ভাবলাম স্বপ্ন-টপ্ন দেখে উঠেছে। আমি কাঁধটা হালকা করে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললাম, মিলি, আমি! আমাকে চিনতে পারছো না? বউ চোখ মেলে ভালো করে তাকিয়ে বলল, ও আপনি? আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি শ্বশুরবাড়ি আছি। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক চিনতে পেরেছে। এরপর একের পর এক চলতে শুরু করল তার ভুলোমনের কান্ড । তার কান্ড কারখানায় কখনো হাসি, কখনো কাঁদি। একবার এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দাওয়াত ছিল। একসঙ্গে যাওয়ার সুযোগ হলো না। ওকে বললাম চলে আসতে। আমি অফিস থেকে আসছি। এসে দেখি সে মুখ কালো করে পার্টি সেন্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? সে ব্যস্ত গলায় বলল, কী হয়েছে পরে শুনবে। আগে একটা শপিংমলে চল। আমি বললাম, এখন শপিংমলে গিয়ে কী হবে? যা লাগে ফেরার পথে নিয়ে নেব। বউ বলল, না এখনই যেতে হবে। আমি ভুল করে পারফিউমের বদলে পোকামাকড় মারার স্প্রে গায়ে দিয়ে এসেছি। ভিতরে ঢুকলে মানুষ কেমন যেন করছে। এই তাহলে ব্যাপার। এতক্ষণ ধরে গন্ধটা আমিও টের পাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম রাস্তার কোথা থেকে আসছে। অগত্যা শপিং মল খুঁজতে বের হলাম। অনেক খুঁজে একটা শপিংমল থেকে ভালো দেখে একটা পারফিউম কিনে ফিরে এসে দেখি পার্টি প্রায় শেষ। লাস্ট ব্যাচের খাওয়া চলছে।  কোনোরকমে দুইটা চেয়ার ম্যানেজ করে খেয়ে ফিরলাম। খালি পার্টি-ফার্টি নয় নিত্যদিন চলছে তার ভুলোমনা কাজ-কারবার। তরকারিতে লবণের বদলে চিনি, চিনির বদলে লবণ এগুলো তো রোজকার ঘটনা। একবার আমার কলিগদের চা পাতার বদলে গোটা জিরা দিয়ে চা বানিয়ে দিয়েছিল। এ নিয়ে এখনো অফিসে হাসাহাসি চলে। আরেকবার বউ এক চোরকে আমার বন্ধু ভেবে বাসায় এনে খাইয়েছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে চোর আমার বউয়ের মোবাইল, ঘড়ি, পাওয়ারব্যাংকসহ প্রায় হাজার পঞ্চাশেক টাকার জিনিস নিয়ে ভেগেছে। উল্টো স্যান্ডেল আমি পরি না। আমার বউ পরে। তাকে কোনো কিছু খুঁজতে বলা মানে দিন শেষ। সে রিকশাওয়ালাকে বিশ টাকার বদলে পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে চলে আসে। বাসায় ফিরে টাকা খুঁজতে গিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে। তবে তার এই স্বভাবের কিছু উপকারী দিকও আছে। একবার বাসায় গ্রাম থেকে দুজন আত্মীয় এলো। বাবা ও ছেলে। আমাদের সরাসরি আত্মীয় নন। বহু দূরের প্যাঁচানো ধরনের আত্মীয়। বাবার গেঁটে বাতের ব্যথা। ডাক্তার দেখাবেন। ছেলে চাকরি খুঁজবে। অনির্দিষ্টকালের আগমন। আমি পড়লাম মহাবিপদে। এই দুর্মূল্যের বাজারে দুটো বাড়তি মানুষের খরচ কম কথা নয়। কবে ভদ্রলোকের গেঁটে বাত সারবে আর কবে ছেলে চাকরি পাবে তা কে জানে? এই বিপদে এগিয়ে এলো আমার ভুলোমনা বউ। ওর যা তা ধরনের রান্না খেয়ে আমাদের এক রকম অভ্যেস হয়ে গেছে। মাঝে-মধ্যে ভালো-মন্দ খেতে হলে আমি তদারকি করি। এবার পুরোটাই ছেড়ে দিলাম মিলির ওপর। প্রথম দিন সব ঠিকঠাক ছিল। পরের দিন খেতে বসে দেখি মিলি মাংসে লবণের বদলে চিনি দিয়েছে। আমি চুপচাপ খেয়ে উঠলাম। বাপ-বেটা খেতে পারল না। এর পরদিন ও ভুল করে মরিচের গুঁড়া দিয়ে  ফেলেছে দুবার। সেদিনও তাদের খাওয়া হলো না। আরেকদিন আমার পুরনো প্যান্ট মনে করে ওই ছেলের জিন্স কেটে লুছনি বানিয়ে ফেলল। বাপের লুঙ্গি দিয়ে ঘর মুছে ফেলল একদিন। আরও নানা কান্ড চলতে লাগল। মিলির এহেন অত্যাচারে পাঁচ দিনের মাথায় গাঁট্টাবোচকা গোল করে বেঁধে ভাগল বাপ-বেটা। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। মনে হলো, নাহ ভুলোমনা একটা বউ থাকা খারাপ না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর